মনের মধ্যে ঝড়

এক্সক্লুসিভ
এক্সক্লুসিভ

কাকতালীয়ভাবে দিনটি মিলে গিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের গৌরবের একটি দিনের সঙ্গে। ১৯৯৯ সালের ৩১ মে নর্দাম্পটনে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের বিশ্বকাঁপানো ওই জয়। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আপসেটগুলোর একটিতেই যেটির তাৎপর্য সীমাবদ্ধ নয়। ওই জয়টিতেই যে স্থাপিত বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসের ভিত্তিপ্রস্তর।
চৌদ্দ বছর পর ওই দিনটিতেই প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকটা জুড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় কলঙ্কের খবর। অনেক বছর ধরেই ক্রিকেটের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে ফিক্সিংয়ের যে ঘুণপোকা, বাংলাদেশের ক্রিকেটও সেটির বিচরণক্ষেত্র জেনে বিস্ময়-হতাশা-ক্ষোভের অনুভূতিতে ছেয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। আর আমি তো এরও সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই ওই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন। ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশ কম অপদস্থ হয়নি, ওই সব দিনে আবেগে টইটম্বুর কোনো সমর্থক যখন ক্ষুব্ধ হয়ে ‘লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না’ বলে ফেলতেন; প্রতিবাদ করতাম, ‘খেলায় হারলে এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? বাংলাদেশ যখন দুর্নীতিতে বিশ্বে এক নম্বর হয়, তখন কেন লজ্জা পান না?’ তিন দিন ধরে হূদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া প্রতিবেদনগুলো তৈরি করার সময় বারবার তা মনে হচ্ছিল। এবার তো বাংলাদেশের ক্রিকেট সত্যি সত্যিই ‘লজ্জায় মুখ দেখাতে না পারা’র কারণ হয়ে দাঁড়াল! আর সেটির কেন্দ্রবিন্দুতে কি না মোহাম্মদ আশরাফুল!

সেই আশরাফুল, একসময় যাঁর ব্যাট বয়ে বেড়াত পুরো দেশের আবেগ। সেই তিনিই যে এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গাটা নিয়ে ছেলেখেলা করেছেন, এটা জেনে ক্ষোভের চেয়ে দুঃখই বেশি হয়েছিল প্রথমে। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবে দুনিয়া-কাঁপানো টেস্ট অভিষেকের স্মৃতি মনে পড়ছিল বারবার। বিশ্বসেরাদের কাতারে তাঁর নাম লেখানোর সামর্থ্য নিয়ে সেই যে নিঃসংশয় হয়ে গিয়েছিলাম, মাঝখানে এতগুলো বছরে মাঝেমধ্যে আনন্দ আর প্রায় নিয়মিতই হতাশা উপহার দেওয়ার পরও সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেনি কখনো। সেই আশরাফুল যে এর চেয়েও বড় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা করে বসে আছেন, এই দুঃখ কোথায় রাখি!

গণমাধ্যমের সামনে আশরাফুল ছবি: শামসুল হক
গণমাধ্যমের সামনে আশরাফুল ছবি: শামসুল হক

আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের (আকসু) কাছে বিপিএলে ফিক্সিংয়ের কথা স্বীকার করেছেন, এই কথা বাতাসে উড়ছিল, যা শুনে খুব একটা বিস্মিত হইনি। বরং নিজের বিচার-বিবেচনাবোধের ওপর আস্থাটা আরেকটু বেড়েছিল। বিপিএল শুরুর আগে থেকেই যে এমন কিছু অবশ্যম্ভাবী বলে জানতাম। যে খেলার মূল উদ্দেশ্য থাকে শুধুই ব্যবসা, সেটিতে খেলার নৈতিকতা আর অনৈতিকতার সীমারেখা মুছে যেতে বাধ্য। এই বিশ্বাসের কথা সোচ্চারে সবাইকে জানিয়েও এসেছি। বিপিএলে ফিক্সিং নিয়ে হইচইয়ের সময় অনেকেই তাই বলেছেন, ‘ভাই, আপনি ঠিকই বলেছিলেন।’ কিন্তু যখন জানলাম, বিপিএলে আশরাফুলের কুকীর্তি হিমশৈলের চূড়ামাত্র, তখন আমি সত্যিই বিস্ময়ে বিমূঢ়।
মোহাম্মদ আশরাফুল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত—এটাই বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। আর এখানে শুধু আশরাফুল একা নন, অন্ধকার জগতে তাঁর সহবাসিন্দা হিসেবে চলে এল বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড় বড় আরও তিনটি নাম। আকসুকে আশরাফুল সুনির্দিষ্টভাবে ওই তিনজনের নাম বলেছেন। সবিস্তারে জানিয়েছেন কীভাবে ওই তিনজন তাঁকে ওই অন্ধকার জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়েও তাঁদের অন্তত দুজনের ফিক্সিংয়ে সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে এসেছে তাঁর জীবনের কলঙ্কিত অধ্যায়ের বর্ণনায়। আশরাফুলের ওই জবানবন্দি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরও পত্রিকায় তা ছাপা হওয়ার আগে সাংবাদিকতার বেশ কিছু শর্ত পূরণ করার ব্যাপার ছিল। মনের মধ্যে বইতে থাকা ঝড়কে চাপা দিয়ে মিলিয়ে নিতে হচ্ছে নানা কিছু। খুঁজতে হচ্ছে নানা প্রশ্নের উত্তর। ওই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়টায় অনুক্ষণ সঙ্গী হয়ে ছিলেন ক্রীড়া বিভাগের সহকর্মী তারেক মাহমুদ। আর বরাবরের মতো মাথার ওপর ছায়া হয়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তো ছিলেনই। সাংবাদিকতার নীতিমালা নিয়ে অসম্ভব খুঁতখুঁতে। লেখাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে ফাঁকফোকর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভেবেছেন এই ‘বোমা’ ফাটানোর পর অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া নিয়েও। ‘কী কী হতে পারে’—সম্ভাব্য এই তালিকায় ‘আদালত’ও ছিল। যেটি মাথায় রেখে একাধিক আইনজীবীর সঙ্গেও কথা বলেছেন। এতেই তো শেষ হয়নি তাঁর কাজ। এমনিতেই উত্তেজনাপ্রবণ আমি তখন আবেগের নৌকায় সওয়ার। সম্পাদক মহোদয়কে জিজ্ঞেস করলে চুপিসারে হয়তো বলবেন, বাকি সবকিছুর চেয়ে আমাকে সামলানোর কাজটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন!

খবরটার গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে চূড়ান্ত গোপনীয়তাও বজায় রাখতে হচ্ছিল। তিন-চার দিন ধরে প্রস্তুতি চলেছে। কিসের প্রস্তুতি, পুরো অফিসে শুধু চার-পাঁচজনেরই তা জানা ছিল। প্রথম আলোর গ্রাফিকস রুমের বদলে প্রথম পৃষ্ঠার ওপরের অর্ধেকটা মেকআপ হয়েছে আমার রুমে, যেখানে প্রবেশাধিকার ছিল সংরক্ষিত। প্রেস থেকে ছাপা হয়ে আসা পত্রিকা দেখে প্রথম আলো অফিসেও তাই ‘বোমা’ ফাটার মতো অনুভূতি। নিউজরুমে সম্পাদকের টেবিলের উল্টো দিকে বসে আমি তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছি। আশরাফুলের ওই বড় ছবি। পাশে খালেদ মাহমুদ, খালেদ মাসুদ ও মোহাম্মদ রফিক। এঁদের নিয়ে কত গৌরবগাথা লিখেছি! দেশে, দেশের বাইরে কত সময় কেটেছে আড্ডায়, কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিন্দুমাত্র টানাপোড়েনও হয়নি কখনো। অথচ এঁদের নিয়েই এমন লেখা লিখতে হলো! সাংবাদিকতার কাজটাকে এই প্রথম বড় নিষ্ঠুর বলে মনে হচ্ছে।

পরদিন থেকে সারা দেশে তোলপাড়, টেলিভিশনে টক শোতে ঝড়—অনেকে অনেক প্রশ্নও তুলেছেন। সাংবাদিকতার নীতিমালা শেখানোর চেষ্টাও কম হয়নি। তাঁরা যদি জানতেন, আশরাফুলের সঙ্গে ওই তিনজনেরও ছবি ছাপানো ঠিক হবে কি না, এ নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করেছি। সাংবাদিকতার নীতি লঙ্ঘিত না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবেই হয়েছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আশরাফুল এবং বিপিএল অংশ এরই মধ্যে প্রমাণিত। বাকিটুকুও একদিন প্রমাণ হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের হাতে তোলা। এ নিয়ে কোনোই মাথাব্যথা নেই, বলাটা ঠিক হবে না। কিঞ্চিৎ আছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণ না হলেই বা কী আসে-যায়! সাংবাদিকের কাজ হলো মানুষকে সত্যটা জানানো। আমি যা লিখেছি, তা সেই দায় থেকেই এবং সেটি সন্দেহাতীত সত্য বলে নিশ্চিত হয়েই।

সাংবাদিকের আরেকটি দায়ও আছে—সূত্র গোপন রাখা। প্রথম আলোতে তাঁর কুকীর্তি প্রকাশিত হওয়ার পর আশরাফুল সংবাদমাধ্যমের কাছে যখন বললেন, ‘আমি এক বড় ভাইকে বলেছিলাম, উনি গাদ্দারি করেছেন’; অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন, এই ‘গাদ্দার বড় ভাই’টা কে? সূত্র গোপন রাখার দায় থেকে আমি হেসে এড়িয়ে গেছি। সেই হাসিতে অবশ্য একটা অনুচ্চারিত প্রশ্নও ছিল—সেই ‘বড় ভাই’ যে-ই হোক, আশরাফুলের মুখে কি কারও বিরুদ্ধে ‘গাদ্দারি’র অভিযোগ শোভা পায়? গাদ্দারি মানে তো বিশ্বাসঘাতকতাই, তাই না? তা এটি আশরাফুলের চেয়ে বেশি আর কে করেছেন! সমর্থকদের সঙ্গে, মানুষের ভালোবাসার সঙ্গে, ক্রিকেটের সঙ্গেও কি নয়!

উৎপল শুভ্র: ক্রীড়া সম্পাদক