ভূগর্ভস্থ পানির সুরক্ষা হচ্ছে না
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের একটি গ্রাম বড়গুন। গ্রামটি বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। শুকনা মৌসুমে এ অঞ্চলে পানির বড় কষ্ট। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। অনেক এলাকার হস্তচালিত নলকূপ অকেজো হয়ে যায়। এ কষ্ট লাঘবে সাবমারসিবল পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুপেয় পানির জন্য পানির এই ব্যবস্থাপনা, কৃষির জন্য নয়। তবে বড়গুন গ্রামের সাবমারসিবল পাম্পের পানি যাচ্ছে কৃষিজমিতেও।
ঝিলিম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লুৎফুল হাসান জানান, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় এসব পাম্প স্থাপন করা হয়। তাঁর কথা, ‘প্রায় সব গ্রামেই সাবমারসিবল পাম্পের সুপেয় পানি কৃষিজমি শুধু নয়, মাছ চাষের জন্য পুকুরেও দিতে দেখেছি। এসব দেখার কেউ নেই।’
বরেন্দ্র এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি বললেন, বাস্তব অর্থেই কোন এলাকা থেকে কী পরিমাণ পানি আহরণ করা যাবে, এসব ঠিক করার মতো কারিগরি তথ্য এসব কমিটির হাতে থাকে না। সেবা দেওয়ার মতো কারিগরি জ্ঞান তাদের নেই। পানিসংক্রান্ত সরকারের নানা সংস্থা থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠানও নেই।
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থাপনায় একটি একক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ বছর দুয়েক আগে নেওয়া হলেও তা থমকে আছে। এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘ভূগর্ভস্থ পানি: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা’।
বাংলাদেশে তিনটি বড় ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার হয়। এর মধ্যে কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এরপর আছে শিল্প এবং গৃহস্থালি।
বাড়ছে চাহিদা, নামছে পানির স্তর
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ১ হাজার ২৭২টি কূপের মাধ্যমে দেশের ভূগর্ভস্থ পানির বাড়া-কমা পর্যবেক্ষণ করে। সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে পানি পাওয়া যেত। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২০ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। আর পানির স্তর নেমেছে ৭৪ মিটার।
দিন দিন কৃষিতে সেচের কাজে পানির ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় রয়েছে। শুকনা বোরো মৌসুমে সেচের পানির প্রায় ৭৫ ভাগের উৎস ভূগর্ভস্থ পানি। দেখা যাচ্ছে, সেচের জন্য ১৯৮৫ সালে দেশে নলকূপের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮০০। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ।
বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন পানির স্তর প্রতিবছর নামছে এক ফুট করে। এক দশক আগে গড় নামার হার ছিল আধা ফুট।
পানির খরচ বেশি হওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির অপব্যবহার হচ্ছে প্রচুর। পাউবোর ভূগর্ভস্থ পানি বিজ্ঞান পরিদপ্তরের পরিচালক আনোয়ার জাহিদের নেতৃত্বে কৃষিতে পানির অপচয় নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৫ ভাগ পানিই কাজে লাগে না।
আনোয়ার জাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকের অনেকেরই ধারণা, বেশি পানি দিলে ফসল ভালো হয়। তাই তাঁরা ইচ্ছেমতো পানি দেন।
ভূগর্ভস্থ পানির সুরক্ষা নিয়ে কে কী করে
গ্রাম, ঢাকাসহ বড় নগরের বাইরে পানির সরবরাহে আছে ডিপিএইচই। ঢাকাসহ পাঁচ মহানগরে আছে পাঁচ ওয়াসা। এ দুটি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের অধীন। আর পাউবো পানির স্তর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে। সেচকাজে আছে বিএডিসি।
ডিপিএইচই বা ওয়াসাগুলো বা বিএডিসির মতো পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূগর্ভস্থ পানির সুরক্ষায় কোনো দায় নেই। তবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষার বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা ওয়াসার ৭০ ভাগ পানি ভূ–উপরিস্থিত উৎস থেকে নেওয়ার লক্ষ্য আমাদের।’
যদিও পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) মহাপরিচালক মো. দেলওয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসাগুলো কারও কাছে কোনো জবাবদিহি করার অবস্থায় নেই। পানিসংশ্লিষ্ট আরও যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের মধ্যে একটা সমন্বয় দরকার।
বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে বিধিমালা প্রণয়ন হয়। বিধিমালা অনুযায়ী, গৃহস্থালি ব্যবহার ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলনের লাইসেন্স প্রদান, মনিটর করে যথেচ্ছ উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো ওয়ারপো। সেই ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে ওয়ারপো কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেন দেলোয়ার হোসেন।
ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান খায়রুল ইসলাম প্রথম অলোকে বলেন, ‘ওয়ারপো গত সাড়ে তিন বছরে তাদের কার্যক্রম জনগণের কাছে দৃশ্যমান করতে পারেনি। পানি পরিকল্পনার প্রতিষ্ঠান দিয়ে পানি আইনের বাস্তবায়ন কতটা বাস্তবানুগ এবং তাদের সক্ষমতা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’
একক প্রতিষ্ঠানের ভাবনা
পানিসংক্রান্ত কাজে থাকা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাজের যে সমন্বয়, সরকারি দলিলেও তা পরিষ্কার। আর এ জন্য ভূগর্ভস্থ পানির সুরক্ষায় একটি একক প্রতিষ্ঠান করার ভাবনাও আছে সরকারের। ২০২০ সালের নভেম্বরে এ নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পানি আইন ২০১৩ সংশোধন করা এবং একটি একক প্রতিষ্ঠান করার জন্য প্রস্তাব চেয়ে পাউবোতে একটি চিঠি দেয়। ডিসেম্বর মাসেই এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে তারা। পরে এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই।