ভিত্তি গড়ে দিতে হবে পরিবার থেকে

ডা. রুবিনা ইয়াসমিন

করোনাকালের সম্মুখযোদ্ধা ডা. রুবিনা ইয়াসমিন। তিনি মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক। অতিমারিকালে সামলেছেন গুরুদায়িত্ব। থেকেছেন মানুষের পাশে। দিয়েছেন চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ভরসাও। অবশ্য এই ব্রত নিয়েই তো তিনি চিকিৎসক হয়েছেন। তাঁর পথচলা সব সময় কুসুম বিছানো না থাকলেও উতরে গেছেন আত্মবিশ্বাস আর ইতিবাচক মনোভাবে। সেই গল্পই তিনি শুনিয়েছে প্রথম আলোকে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেখা আপনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন কী কী?

ডা. রুবিনা ইয়াসমিন: ইতিবাচক পরিবর্তন বলতে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই শুরু করতে হবে। বিশেষ করে বলতে চাই আমরা যখন এমবিবিএসে ভর্তি হই, সে সময়ের কলেজের পরিবেশ বর্তমানের মতো শিক্ষার্থীবান্ধব ছিল না। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যার মাধ্যমে এখন ভালো চিকিৎসক তৈরি হয়। পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সম্পর্ক, এরও অনেক উন্নতি হয়েছে। এই উন্নতিটা আমার মনে হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই হয়েছে। মেয়েদের শিক্ষার হার অনেকে বেড়েছে। এটি বড় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। কারণ, একটি দেশকে উন্নত করতে গেলে নারীর শিক্ষা অনেক বেশি প্রয়োজন। আমাদের দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। আর্থিকভাবে মানুষ যেমন সচ্ছল হয়েছে, তেমনই সামাজিক প্রেক্ষাপটের উন্নতি হয়েছে। মেয়েরা এখন ঘর থেকে বাইরে যেতে পারছে। তারা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে। মেয়েরা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। প্রান্তিক জনগণও আধুনিক নানা ধরনের সেবা ভোগ করছে। পশ্চিমা বিশ্বের মতো অনেক সুযোগ-সুবিধাও আমরা পাচ্ছি। সুতরাং সে জায়গা থেকে বলতে হলে বলা যায়, আমাদের দেশ বেশ ভালোভাবেই এগিয়েছে।  

প্রশ্ন:

নারীর কর্মক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন।

ডা. রুবিনা ইয়াসমিন: এ বিষয়ে বলতে গেলে আমার কিছু কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে হবে। যেমন আমি যখন কর্মজীবন শুরু করি, তখন আমার প্রথম পোস্টিং ছিল ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তখন যাতায়াতব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। কিন্তু এখন যাতায়াতব্যবস্থা খুবই ভালো। এরপর আমার কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ হয় টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলায়। সে সময় জায়গাটি ছিল একেবারেই প্রান্তিক। টেম্পো, নৌকা, রিকশায় করে যেতে হতো। কিন্তু এখন সহজেই সেখানে পৌঁছানো যায়। সুতরাং বর্তমানে একজন নারীর জন্য সেখানে গিয়ে কাজ করা খুব একটা কঠিন কাজ না। আবার যদি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অবকাঠামোর কথা বলা হয়, বর্তমানে তা অনেক আধুনিক। আগে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর সেবাদান ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে চিকিৎসাপদ্ধতিও অনেক উন্নত হয়েছে।

প্রশ্ন:

আপনার ক্যারিয়ারের সন্ধিক্ষণ কোনটি ছিল?

ডা. রুবিনা ইয়াসমিন: চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে কর্মজীবনের সন্ধিক্ষণ হচ্ছে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন। যতক্ষণ পর্যন্ত পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ না হয়, তত দিন পদোন্নতি হয় না। সুতরাং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করাই ছিল আমার কর্মজীবনের সন্ধিক্ষণ।

প্রশ্ন:

‘নারী’ বলে কোনো বাধা এসেছে কি?

ডা. রুবিনা ইয়াসমিন: এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, আমার বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। আমরা পাঁচ বোন। বাবা আমাদের সবাইকে শিক্ষিত করেছেন। আমরা দুই বোন চিকিৎসক। বাকিরা সবাই মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা। আমার বাবা আমাদের সব ভাইবোনদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। সুতরাং পরিবার থেকে কখনো কোনো বাধা আমার জন্য তৈরি হয়নি। আবার বিয়ের পরও আমার স্বামী কখনো আমাকে বাধা দেননি। আমি পড়তে চেয়েছি, কাজ করতে চেয়েছি, তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন। সামাজিকভাবেও তেমন কোনো বাধা আমার সামনে আসেনি। আমি পুরুষের পাশে থেকে কাজ করেছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। সুতরাং আমি মনে করি, মেয়েদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন। কারণ, মেয়েরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলে অনেক বাধাকেই সহজে অতিক্রম করতে পারবে। আর এর ভিত্তি পরিবার থেকেই গড়ে দিতে হবে। তবেই সব বাধা পেরিয়ে মেয়েরা সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।

প্রশ্ন:

এ সময়ে তরুণের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

ডা. রুবিনা ইয়াসমিন: প্রথমত, তরুণদের একটি লক্ষ্য অবশ্যই থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিজের কাছে নিজেকে সৎ থাকতে হবে। তৃতীয়ত, দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইচ্ছাকৃতভাবে কারও ক্ষতি করা যাবে না। তিনি পরিবার বা সমাজের যেকেউ হোক না কেন, কারও কোনো ধরনের ক্ষতি করা যাবে না। উপরন্তু, সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে।

সাক্ষাৎকার: জাহিদুল হক