২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ভালো-মন্দ নিয়ে মনোহরদী-বেলাব

>
নূরুল মজিদ মাহমুদ,সাখাওয়াত হোসেন
নূরুল মজিদ মাহমুদ,সাখাওয়াত হোসেন
* তফসিল ঘোষণার পর মনোহরদী ও বেলাব উপজেলায় হামলা–ভাঙচুর চলেছে
* নরসিংদী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন (বর্তমান সাংসদ)
* বিএনপির হয়ে সাবেক সাংসদ সরদার সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন
* সম্পর্কে দুজন আপন মামাতো-ফুপাতো ভাই
* নির্বাচনী লড়াইয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় নেই


বেলা গড়িয়ে বিকেল। ভাঙা রাস্তা, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে গতকাল বুধবার পৌঁছালাম নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বাজনাব ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে। খুঁজছি কামরুল হাসানের বাড়ি। জিজ্ঞেস করতেই দুই যুবক ইশারায় বাড়িটি দেখিয়ে চলে গেলেন। দ্বিতল পাকা বাড়ি। সব কটি জানালারই কাচ ভাঙা। ভেতরে আসবাবের টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গ্যারেজে রাখা গাড়িটিও ভাঙা। ফটকে ঝুলছে তালা। বাসিন্দারা সবাই এখন বাড়িছাড়া। নির্বাচনী সহিংসতার ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি।

তালাবদ্ধ বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর এলেন এক বৃদ্ধ, শিশু কোলে এক নারী ও কয়েকজন তরুণী। তাঁরা জানালেন, কামরুল সিঙ্গাপুরে থাকেন, প্রায়ই দেশে আসেন। গত মঙ্গলবার সকালে তিনি বাড়ি এসেছিলেন। দুপুর ১২টার দিকে কালো ও সাদা রঙের দুটি মাইক্রোবাসে একদল লোক আসেন। তাঁদের হাতে ছিল রামদা-পিস্তল। কামরুল পালিয়ে বাঁচলেও বাড়িটি ওই লোকেরা তছনছ করে চলে যান। পরে পুলিশ এসেছিল। মঙ্গলবার রাতেই অন্য এলাকা থেকে পুলিশ কামরুলকে আটক করে, পরে ছেড়ে দিয়েছে। কামরুলের অপরাধ কী? বৃদ্ধের উত্তর, ‘সে বিএনপি করে, এইডাই অপরাধ। এমুন ঘটনা এলাকায় জীবনেও দেখছি না।’

বৃদ্ধ তাঁর জীবনে এমন ঘটনা না দেখলেও মনোহরদী ও বেলাব উপজেলার আরও অনেকেই এবার এমন ঘটনা দেখেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেখানে অন্তত ১৬টি বাড়ি ও বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙচুরের তথ্য পাওয়া গেছে। বাড়ি ও দোকানগুলোর মালিক বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

এমন ভাঙচুর ছাড়াও গণসংযোগে হামলা, পুলিশের হাতে আটক, আটকের পর টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া আর ঢালাও গ্রেপ্তারের অভিযোগও আছে। তবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের পরিবেশকে ভালোই বলছে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে এখন মনোহরদী ও বেলাব উপজেলা।

এই উপজেলা দুটি নিয়ে নরসিংদী-৪ আসন। এবার এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন (বর্তমান সাংসদ)। আর বিএনপির হয়ে সাবেক সাংসদ সরদার সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন করছেন। সম্পর্কে দুজন আপন মামাতো-ফুপাতো ভাই। কিন্তু নির্বাচনী লড়াইয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় নেই।

গতকাল সকালে মনোহরদী থানার সামনে কথা হয় স্থানীয় এক ভোটারের সঙ্গে। ভোটের কী অবস্থা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নৌকা বেশি ক্ষমতা দেহায়, ধানের শীষের প্রচার দেহা যায় না।’ থানা থেকে মনোহরদী বাসস্ট্যান্ড ও আশপাশের এলাকা ঘুরে ধানের শীষের তেমন কোনো পোস্টার দেখা যায়নি। লাঙ্গল, গোলাপ ফুল, হাতপাখার পোস্টার চোখে পড়েছে।

বাসস্ট্যান্ডে একটি চায়ের দোকানে ৮-১০ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মাথার ওপর নৌকার পোস্টার ঝুলছে। তাঁরা নানা বিষয়ে কথা বলছেন। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আলাপ নেই। জানতে চাইলে দোকানি বলেন, একতরফা নির্বাচন, আগের মতো আলোচনা হয় না। কারণ, নৌকার বাইরে কথা বলার সুযোগ নেই। উপজেলায় বিএনপির কোনো অফিস আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নেতারাই নাই, আর অফিস!’

নেতাদের সন্ধান না পেয়ে যোগাযোগ করা হলো বিএনপির প্রার্থী সরদার সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বাড়িতে আছেন, মনোহরদী বাসস্ট্যান্ড থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি। দুপুরের দিকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেখা গেল, ২০-২৫ জন কর্মী বসে আছেন। নির্বাচনের কী অবস্থা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই যে বাড়িতে বসে আছি, বের হওয়ার উপায় নেই।’ তাঁর অভিযোগ, প্রতিপক্ষের হামলা ও পুলিশের গ্রেপ্তারের কারণে চতুর্থ সারির নেতারাও এলাকায় থাকতে পারছেন না। এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাবাকে না পেলে ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গণসংযোগের জন্য তিন দিন বের হয়ে দুই দিন হামলার শিকার হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘এসব হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান সাংসদের ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ।’ প্রথম আলোর পক্ষে এই অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এ সম্পর্কে জানতে মঞ্জুরুল মজিদ ও তাঁর বাবা আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল মজিদকে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু দুজনের নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াশীষ রায় বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো বাধা বা হামলা করা হচ্ছে না। ২০০১ সালে বিএনপির অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে জনগণ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ জন্য তাদের প্রচার-প্রচারণা কম। এলাকার নির্বাচনের পরিবেশ ভালো।

গ্রেপ্তার-আটকের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাহমুদ বলেন, ‘ঢালাওভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, শুধু মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’ টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ারও অভিযোগ সত্য নয় বলে তিনি জানিয়েছেন।

বেলাবর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চরউজিলাব বাজারে পৌঁছাতে পড়ন্ত বিকেল। বাজারে নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল, কাস্তে ও সিংহ প্রতীকের পোস্টার ঝুলছে। একটি চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। টিভিতে চলছে বাংলা সিনেমা। সবাই মনোযোগী দর্শক। একজনের কাছে জানতে চাইলাম, ‘ভাই, ভোটের কী খবর?’ ঘাড় না ঘুরিয়েই বললেন, ‘ভোটের খবর অত রাহি না।’