যমুনার ভাঙনে সাজানো সংসার তছনছ
চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সাজানো-গোছানো সংসার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. ওয়াজেদ আলীর। নদীভাঙনের কারণে তাঁর সেই সংসার এখন তছনছ। নিজের ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় হয়েছে পরিবারটির। নদীতে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব তাঁরা। গত মঙ্গলবার ওয়াজেদ আলীর চারটি বসতঘরসহ ১০ শতাংশ জমি নদীগর্ভে চলে গেছে।
ওয়াজেদ আলী ১০ বছর আগেও একবার ভাঙনের শিকার হয়েছিলেন। আগের স্থান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে এসে এখানে নতুন করে সংসার সাজিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালোই কাটছিল দিনগুলো। ১০ বছর পর আবারও সেই ঘরবাড়ি ও জমি নদীগর্ভে চলে গেল।
ওয়াজেদ আলীর বড় ছেলের একটি দোকান ছিল বাজারে। গত শনিবার সেটাও নদীগর্ভে চলে গেছে। বর্তমানে খোলাবাড়ি রাস্তায় বাকি কিছু আসবাব রেখেছে পরিবারটি। ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছি না। বর্তমানে আমি নিঃস্ব। কত দিন ধরে নদী ভাঙছে, তারপরও ভাঙনরোধে সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিল না। এত বড় বাজারের অর্ধেক এখন যমুনার পেটে। আর কত মানুষ সর্বস্বান্ত হলে সরকারের টনক নড়বে।’
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, নদীভাঙন অব্যাহত আছে। বিশাল আকারে মানুষের জমিজমা ভেঙে পড়ছে। রুবি বেগমের রান্নাঘরের চুলা পর্যন্ত ভাঙন চলে আসছে। তিনি তাঁর ঘরবাড়ি সরাতে খুব ব্যস্ত। ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে পূর্ব পাশের একটি খোলা মাঠে রাখছেন। সাহারা বেগম বাড়ির উঠানে থাকা একটি আমগাছ কেটে সরাচ্ছেন। কথা বলার সময়ও নেই তাঁর। প্রতিনিয়ত নদীর পাড় ভেঙে পড়ছে। তামান্না আক্তার নিজের ঘরের বেড়া সরাচ্ছেন। সঙ্গে তাঁর স্বামী রেজাউল করিমও। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘরবাড়ি সরাতে খুব ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁদের মতো মনোয়ারা বেগম তাঁর ঘরের মেঝের ইট সরাচ্ছেন। সবার মতো আসমা বেগমও তাঁর বাড়ির সামনে থাকা ঝাড়ের বাঁশ কেটে সরাচ্ছেন। রফিকুল ইসলাম তাঁর ঘরের বেড়া মাথায় করে অন্যত্র নিচ্ছেন। এভাবেই প্রতিটি পরিবার নিজেদের আসবাব সরাতে ব্যস্ত। তাঁদের খাওয়া-দাওয়া নেই। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাচ্ছে। কোথাও ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা লক্ষ করা যায়নি।
গত সাত দিনে ইমরান হোসেন, সাফি মিয়া, মাসুদ শাহ্, নূর মোহাম্মদ, মো. রুকন, জুবায়ের হোসেন, আবদুস ছালাম, রফিক মিয়া, আবদুর রহিম, মোহাম্মদ রিপন, শাহ আলম, আবদুস সামাদ, মালেক শাহ্, সুনা মিয়া, আবদুল হক, আরফান আলী, নূর ইসলাম, ওমর আলী, আল আমিন, লিটন মিয়া, মোহাম্মদ গোলাম, মোখলেছুর রহমান, মুসলিম উদ্দিন, আবদুর জব্বার, সাদেক আলী, জামাল মিয়া, কবুল মিয়া, মাসুদ মিয়া, কাফি মিয়াসহ অর্ধশত মানুষের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। এভাবে গত কয়েক মাসে খোলাবাড়ি এলাকার প্রায় তিন শতাধিক ঘরবাড়িসহ বিস্তীর্ণ জনপথ নদী গিলে নিয়েছে।
জুবায়ের হোসেন বলেন, নদীভাঙনে বসতভিটা, ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজারসহ বিস্তীর্ণ জনপথ এখন যমুনার গর্ভে। একসময়ের অনেক জমির মালিক এখন ভূমিহীন। ছিন্নমূল জীবন যাপন করছে প্রায় তিন শতাধিক পরিবার। এসব পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশ খোলাবাড়ি রাস্তার দুই পাশে ও খোলা মাঠে ঝুপড়ি তুলে বসবাস করছেন। অনেকে চলে গেছেন আত্মীয়স্বজন ও ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে। ভাঙনরোধে প্রথম দিকে কিছু বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। অল্প জিও ব্যাগ কোনোই কাজে লাগেনি। এত অসহায় পরিবারের পাশে সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্য–সহযোগিতা এখনো আসেনি।
মনোয়ারা বেগম জানান, তিন-চার মাস ধরে নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নদী সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাঁদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। গৃহহারা হয়েছে কয়েক শ পরিবার। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে জীবন পার করছেন। কিন্তু কেউ তাঁদের সাহায্য করতে এলো না। তিনি বলেন, ‘আমরা মরে গেলে কি সরকারের টনক নড়বে?’
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সোলাইমান হোসেন বলেন, এই উপজেলার সবচেয়ে বড় এলাকা খোলাবাড়ি। খোলাবাড়ি বাজারটি একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। সেখানে নবনির্মিত নৌ–থানাও রয়েছে। গত দুই-তিন মাসের মধ্যে প্রায় তিন শতাধিক পরিবার গৃহহারা হয়েছে। বাজারের প্রায় অর্ধেক ভেঙে গেছে। অনেক পরিবার এখন রাস্তায় ছিন্নমূল জীবন যাপন করছে। ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ নানা জায়গায় কথা বলছেন সবাই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভাঙনরোধে পাউবোর কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। তা না হলে দেওয়ানগঞ্জ থেকে খোলাবাড়ি গ্রামটি পুরো হারিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাইদ বলেন, খোলাবাড়ি এলাকার ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি। জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজ করা হয়েছে। জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে বাজারটি রক্ষার চেষ্টা চলছে। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলছে। সেখানে স্থায়ীভাবে কাজ করার জন্য একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন।