বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ, উন্মুক্ত স্থানে ঈদের ঘোরাঘুরি
হবিগঞ্জের কিশোর ইসমাইল ঢাকার বাড্ডা এলাকার একটি হোটেলে কাজ করে। করোনায় দূরপাল্লার বাস চালু না থাকায় ইসমাইল ঈদে গ্রামে যেতে পারেনি। আজ শুক্রবার সকালে বাড্ডা এলাকার একটি মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করে সে। এরপর দুপুর ১২টার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ইসমাইল চলে আসে দোলাইরপাড়ের গীত-সঙ্গীত সিনেমা হলে।
ইসমাইল বলল, ‘আমি কোনো দিন হলে বসে সিনেমা দেখিনি। করোনায় বাস বন্ধ। বাড়ি যেতে পারিনি। বাবা-মাকে ছাড়া ঈদ ভালো লাগছে না। তবে ঈদের নামাজ পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছি। হলে সিনেমা দেখতে এসেছি। খুব ভালো লাগছে।’
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিনে মানুষ নামাজ আদায় করে শিশুদের নিয়ে ঘুরতে বের হয়। চিড়িয়াখানা, পার্কগুলোয় মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকে। প্রতিবছর এমনটাই হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব স্থানে। তবে গত বছর ঈদের দিনে রাজধানীতে মানুষের চলাচল ছিল কম। এবারের চিত্র একেবারই আলাদা।
করোনায় গত বছরের মতো এবারও খোলা জায়গার পরিবর্তে মসজিদে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছে মানুষ। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ঈদ পালনের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। করোনার বিধিনিষেধে বন্ধ জাতীয় চিড়িয়াখানাসহ নগরের বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র। তবে সাধারণ মানুষ, শিশু-কিশোরেরা ঘর থেকে বের হয়েছে। রাস্তাঘাটে মানুষ যে যার মতো করে ঘুরছেন। অনেকে পরিবার নিয়ে রিকশায় করে ঘুরছেন। হাতিরঝিল, গুলশান লেক, ধানমন্ডি লেকসহ নগরের নানা স্থানে মানুষ ঘুরছেন। আবার অনেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে রাজধানীর আশপাশের এলাকায় ঘুরতে বের হয়েছেন। বিশেষ করে কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ ও দোহারের সড়কের ধারে ঘুরতে বের হয়েছেন অনেকে।
রমনা পার্ক বন্ধ থাকলেও রমনা পার্ক এলাকায় শিশুসন্তানসহ ঘুরতে এসেছেন আবু তালহা দম্পতি। তাঁরা থাকেন মিরপুরে। আবু তালহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ ভালো নেই। পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশন খুললে নেতিবাচক খবর বেশি। শিশুদের স্কুল বন্ধ। ঢাকার মতো ইট-পাথরের শহরে একটি শিশু কত দিন ধরে ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে পারে? বাস বন্ধ। ঈদের ছুটিতে গ্রামে যেতে পারিনি। তাই দুই বাচ্চাকে নিয়ে রমনা এলাকায় ঘুরতে এসেছি। রিকশায় করে ঘুরছি, সিএনজিতে করেও ঘুরছি। আমার বাচ্চারা খুব আনন্দে আছে।’
ঈদের দিন বিকেলে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় শিশু-কিশোরদের উপচেপড়া ভিড় থাকত। অনেকে জানতেন না, গত বছরের মতো এ বছরও চিড়িয়াখানাসহ অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্রগুলো বন্ধ রয়েছে। আজ ঈদের দিন অনেক শিশু-কিশোর ঘুরতে আসে চিড়িয়াখানায়। তবে প্রবেশ ফটক বন্ধ থাকায় অনেক কিশোর-কিশোরী মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যায়।
গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটিতে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে।
বিপদে পড়ে যান নিম্ন আয়ের মানুষ। পরে দোকানপাট, অফিস-আদালত খুললে জনজীবনে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। তবে গত মার্চ মাসের শেষ দিকে করোনার সংক্রমণ ও মানুষের মৃত্যু বেড়ে যায়। আবার গত ৫ এপ্রিল থেকে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধসহ নানা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট।
অবশ্য ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সপ্তাহ দুয়েক পর গত ২৫ এপ্রিল থেকে আবার দোকানপাট খুলে যায়।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারির প্রভাব পড়েছে মানুষের মনে।
মনোচিকিৎসকেরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে চলা করোনা মহামারিতে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। মানুষ প্রতিনিয়ত সংক্রমিত হচ্ছে। এই খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ পত্রিকায়, টেলিভিশনে সব সময় দেখছে। এত মৃত্যু, এত নেতিবাচক খবর শুনে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ পরিত্রাণ চায়।
পুরান ঢাকার বংশালের বাসিন্দা আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের দিনে নামাজ আদায় শেষে খাওয়াদাওয়া করে ঘুরতে বের হবেন, এটাই স্বাভাবিক। নগরের একজন মানুষ, তাঁকে তো টিকে থাকতে সারা বছর কাজ করতে হয়। ঈদের দিনে মানুষ প্রিয়জনের বাসায় ঘুরতে যান, ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে যান, এটাই হয়ে থাকে। তবে করোনায় গত বছরের ঈদের দিনে মানুষ সেভাবে ঘুরতে বের হয়নি। তবে এ বছর মানুষ ঘুরতে বের হয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ ইতিমধ্যে বুঝে গেছে, এই করোনা দীর্ঘ সময় তার সঙ্গী হয়ে থাকবে। মানুষ আর আগের মতো করোনা নিয়ে আতঙ্কিত নয়। মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ মানুষের এই মনোভাবকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। তবে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে ঘোরাঘুরি করে, সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। ঈদের দিনে মানুষ শিশু-কিশোরদের নিয়ে যে ঘোরাঘুরি করছে, সেটি খুবই ভালো।