বিদ্যানন্দের কিশোর, কিশোরের বিদ্যানন্দ
চট্টগ্রাম থেকে পেরু। জীবন ও ভূগোলের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন কিশোর কুমার দাশ। ছিলেন প্রকৌশলী, এখন স্বেচ্ছাসেবী। চুয়েট থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। কোথাও থিতু হতে পারেননি। ভাগ্যবদলের আশায় পাড়ি জমান লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে।
৯ বছর ধরে সেখানেই বসবাস কিশোর কুমারের। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর আজ বাংলাদেশের যুবসমাজের কাছে অনুকরণীয় এক নাম।
একসময় গভীর হতাশায় নিমজ্জিত ছিলেন কিশোর। আত্মহত্যার চেষ্টা করে ভাগ্যজোরে বেঁচে যান। এরপর তাঁর উপলব্ধি হয়, চারপাশের অনেকের জীবনেই রয়েছে সীমাহীন কষ্ট আর দুর্ভোগ। তাদের জন্য কিছু করা যাক। সেই ছোট্ট ভাবনারই পরিণত রূপ আজকের ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’। স্বেচ্ছাসেবী এই সংস্থা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনা করাচ্ছে। অভাবী মানুষের মুখে তুলে দিচ্ছে আহার, মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে। এই ১ টাকায় আহার কার্যক্রমের মাধ্যমেই ২০১৬ সালে আলোচনায় আসে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামের এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের । এরপর ২০১৪ সালের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম শাখা এবং সবশেষে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বরিশালে বিদ্যানন্দের ১৪তম শাখা চালু হয়েছে। ২০১৩ সালে ‘পড়ব, খেলব, শিখব’ স্লোগান নিয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের গোড়াপত্তন করেন কিশোর কুমার। ক্রমেই বিদ্যানন্দের ছায়াতলে যুক্ত হতে থাকেন অনেক তরুণ স্বেচ্ছাসেবী।
শুরুতে কিশোরের ব্যক্তিগত অর্থায়নে কাজ চললেও এখন এগিয়ে এসেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ। সবার প্রচেষ্টাতেই দেশব্যাপী ছড়িয়েছে বিদ্যানন্দের কাজ। বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহী, নীলফামারী, কক্সবাজারসহ মোট ১৪টি শাখা রয়েছে বিদ্যানন্দের। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় ২৫টির বেশি স্থানে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার শিশুর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
বিদ্যানন্দের রয়েছে ছয়টি অনাথ আশ্রম, যেখানে বাস করেছ চার শ জনের বেশি অনাথ শিশু। বান্দরবানের রুমা ও আলীকদম এবং চট্টগ্রামে বিদ্যানন্দের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এ ছাড়া প্রতিদিনের শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম চালু রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রংপুর, রাজশাহী ও খাগড়াছড়িতে।
বিদ্যানন্দের শিক্ষাদান ও খাদ্য বিতরণের পাশাপাশি যোগ হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকদের মাধ্যমে ১ টাকায় চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। চট্টগ্রামের সাগরিকায় রয়েছে মা ও শিশু হাসপাতাল। ৫ টাকায় স্যানিটারি প্যাড, ১ টাকায় চিকিৎসাসহ নানা রকম কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে শত শত নারী ও শিশু।
বিদ্যানন্দের নিজস্ব পোশাক কারখানা ‘বাসন্তী’র মাধ্যমে তৈরি স্যানিটারি প্যাড দেশের প্রান্তিক গোষ্ঠীর কাছে বিভিন্ন রেলস্টেশন ও বস্তিতে ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতিমখানার শিশুদের জন্য টি-শার্ট, স্কুলের পোশাক, চটের ব্যাগসহ অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছে এ কারখানায়। সেখান থেকে বিতরণ করা হচ্ছে শীতবস্ত্র, ঈদের নতুন পোশাক। পবিত্র রমজানে লক্ষাধিক মানুষকে ডিজিটাল ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে ইফতারি বিতরণ করেছে সংগঠনটি।
করোনাকালেও বিদ্যানন্দের ছিল দৃপ্ত পদচারণ। সারা দেশে সবজির দাম যখন লাগামছাড়া, তখন বিদ্যানন্দ দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে ট্রাকে করে সবজি এনে রাস্তার পাশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে বিতরণ করেছে।
এতে উপকৃত হয়েছেন কৃষকেরাও। কারণ লকডাউনের কারণে বাজারে গিয়ে ফসল বিক্রি করতে পারছিলেন না তাঁরা। বিদ্যানন্দ সরাসরি তাঁদের কাছ থেকে সবজি কিনেছে।
এ ছাড়া বিদ্যানন্দ খাবার পৌঁছে দিয়েছে শহরের কিছু কিছু বৃদ্ধাশ্রম ও অনাথাশ্রমেও।
করোনাকালে অনেকেরই আয়রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। করোনায় পুঁজি হারানো মানুষদের আয়ের পথ তৈরি করে দিতে সম্প্রতি ৩ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে সংগঠনটি। ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা, মোংলা ও বরিশালে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ক্রমান্বয়ে উত্তরবঙ্গেও এটি চালু হবে। সামনে শীত আসছে।
শুধু কম্বল বিতরণ নয়, কিছু সৃজনশীল কাজ হাতে নিতে চায় বিদ্যানন্দ। ছিন্নমূল মানুষকে স্লিপিং কিট দিতে চায় বিদ্যানন্দ।
কিশোর কুমারের বুকে লাল সবুজের জন্য ভালোবাসা। সুদূর পেরুতে বাস করলেও মনটা পড়ে থাকে বাংলাদেশের আনাচে–কানাচে। পৃথিবীটা এখন গ্রোবাল ভিলেজ। তিনি প্রতিদিন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কাজের মনিটর করেন পেরুর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেই।
ডিজিটাল যুগে বসবাস করার ফলেই কিশোরের পক্ষে সম্ভব হয়েছে এই অর্জন। স্বল্পভাষী ও নিভৃতচারী মানুষ কিশোর কুমার। তিনি আড়ালে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন।
অনলাইনে কথা হয় কিশোরের সঙ্গে। তিনি মনে করেন, চ্যারিটি কোনো ওয়ান ম্যান শো নয়। এখানে স্বেচ্ছাসেবীরাই মুখ্য। চ্যারিটি খাতে সৃজনশীলতা যুক্ত করা খুব জরুরি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী নিত্যনতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিদ্যানন্দের সব কাজে শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়। অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সব নিয়ম শতভাগ মেনে চলা হয় এবং তথ্য আপ টু ডেট রাখা হয়।
বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীদের সম্পর্কে কিশোর বলেন, স্বেচ্ছাসেবকদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী। বিদ্যানন্দ আবেগনির্ভর প্রতিষ্ঠান নয়, মেধানির্ভর কাজ করার চেষ্টা চলে সব সময়। ৩০ জনের খাবার রান্না দিয়ে শুরু হয়েছিল ১ টাকার আহার কার্যক্রম। ক্রমেই তা ১০০ থেকে ৫০০ জন, ৫০০ জন থেকে এখন সেখানে হাজার হাজার মানুষের জন্য রান্না হচ্ছে। সবই করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা।
ছেলে ও মেয়ে সবাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সবাই সচেতন থাকেন, কোনোভাবেই যেন তাঁদের কোনো কাজ প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। জবাবদিহির বড় জায়গা হচ্ছে মানুষ।
বিদ্যানন্দের হেঁশেলে দরিদ্র মানুষের জন্য যে খাবার রান্না হয়, ওই একই খাবার সংগঠনটির সব স্বেচ্ছাসেবকও খান।
কিশোর আরো যোগ করেন, আমরা চ্যারিটির মাধ্যমে মনুষ্যত্বের পরিবর্তনের আশায় কাজ করি। অভাব বহুরূপ, বিদ্যানন্দ নতুন ক্ষেত্র সন্ধানের পাশাপাশি সেবার নতুন দিক আবিস্কারের চেষ্টা করে। অন্যকে অনুপ্রাণিত করে একইভাবে পথে নামার। বিদ্যানন্দ বিশ্বাস করে এটা সমষ্টির কাজ।
আমরা খুবই সাধারণ মানুষ, পূজনীয় কেউ নই। লোভ, ক্ষোভ, হিংসা নিয়েই জীবন আমাদেরও। জীবনের একটা ধাপে স্বেচ্ছাসেবীরা চ্যারিটিতে কাজ করে আবার ফিরে যায় পেশাজীবনে, এমন হাজার মানুষের সম্মিলিত ফল এই বিদ্যানন্দ।
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য কিশোর কুমারের বার্তা, ‘আসুন, প্রতিবেশীদের প্রতি মানবিক হই।’
● ফিরোজ চৌধুরী: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক