বিএনপির দুর্গে আ.লীগের দাপট
দিনাজপুরে সংসদীয় আসন ছয়টি। বিএনপির দুর্গ হিসেবে খ্যাত খালেদা জিয়ার পৈতৃক নিবাস সদর আসনে বিএনপি প্রার্থীর প্রার্থিতা স্থগিত হয়েছে। এর বাইরে পাঁচটি আসনের তিনটিতে বিএনপি ও দুটিতে জামায়াতের নেতারা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদেরাই ছয়টি আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ছয়টি আসনেই আওয়ামী লীগ দাপটের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে। শেষ দিনে নৌকার প্রার্থীরা সংসদীয় আসনে বড় বড় জনসভা করেছেন। কিন্তু ধানের শীষের নেতা–কর্মীদের প্রতিনিয়ত থাকতে হয়েছে গ্রেপ্তার আর হয়রানি–আতঙ্কে। পার্বতীপুর ও চিরিরবন্দরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জনসভাই ছিল বিএনপির সম্বল। জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া দিনাজপুর-৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত রয়েছেন আত্মগোপনে।
১৫ ডিসেম্বর বিএনপির জেলা কার্যালয়ে ও ২৫ ডিসেম্বর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দিনাজপুরে নির্বাচনী পরিবেশ না থাকা, পুলিশের গ্রেপ্তার–হয়রানির চিত্র তুলে ধরে ধরেন দলের প্রার্থীরা। এর মধ্যেও ব্যতিক্রম ছিল দিনাজপুর-৫ আসন। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমানতালে প্রচার চালিয়েছে।
দিনাজপুর-১: মামলার চাপে প্রচার থেকে দূরে ধানের শীষ
সরেজমিন ঘুরে এবং নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) এবং দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-নবাবগঞ্জ-হাকিমপুর-ঘোড়াঘাট) আসনের নির্বাচনী চিত্র ছিল অনেকটাই আলাদা। দিনাজপুর-১ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ মনোরঞ্জন শীল গোপাল এবং ২০–দলীয় জোটের প্রার্থী জামায়াতের পৌর মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। ওই আসনে দিন–রাত ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
অন্যদিকে, ধানের শীষের প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফকে কিছু প্রচার চালাতে দেখা গেছে। প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করে মোহাম্মদ হানিফ বলেন, তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রচার চালালেও তফসিল ঘোষণার পর জামায়াত–বিএনপির দুই থেকে আড়াই শ নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নৌকার প্রচারে হামলার অভিযোগে তিনিসহ ১৯৯ জন নেতা–কর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে।
দিনাজপুর-২: ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ বিএনপির
দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ আসনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে তিনি ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট চাইছেন, উঠান বৈঠক, গণসংযোগ করছেন। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে আসনের দুই উপজেলা। সাইকেল–শোভাযাত্রার মাধ্যমে নতুন ভোটার নিয়ে তাঁর প্রচার নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ধানের শীষের প্রার্থী উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাদিক রিয়াজ ওরফে পিনাক চৌধুরী। পাড়া–মহল্লায় গিয়ে উঠান বৈঠক, গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি। তবে গত মঙ্গলবার দিনাজপুর প্রেসক্লাবে সাদিক রিয়াজ চৌধুরীর অভিযোগ ছিল, তাঁর নির্বাচনী কার্যালয় ভেঙে ফেলা হচ্ছে, প্রচারে বাঁধা দেওয়া হয়েছে। প্রচারের শেষ দিন ভোরে বিরল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ন ম বজলুর রশিদকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করে। অন্য নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এসব বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি।
দিনাজপুর-৩: বিএনপির প্রার্থী নেই
দিনাজপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম। পুরো আসনে তাঁর পোস্টারে ছেয়ে আছে। উচ্চ আদালতের রায়ে স্থগিত হয়েছে বিএনপির প্রার্থী পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা। এতে করে অনেকটাই বিজয় নিশ্চিত নৌকার। তবে প্রার্থিতা স্থগিতের আগে নেতা–কর্মীদের গণগ্রেপ্তার আর পুলিশ হয়রানির অভিযোগে ১৫ ডিসেম্বর জেলা বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন জাহাঙ্গীর আলমসহ তিন প্রার্থী।
দিনাজপুর-৪: একাই গণসংযোগে বিএনপি প্রার্থী
দিনাজপুর-৪ (চিরিরবন্দর- খানসামা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এই আসনে অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও এখন আবুল হাসান মাহমুদ আলীর পক্ষে মাঠে নেমেছে সবাই। মন্ত্রী দিন–রাত এলাকায় গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন। প্রচারের শেষ দিনে চিরিরবন্দর ও খানসামায় দুটি বড় জনসভাও করেছেন তিনি।
তবে এ আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর পোস্টার–ব্যানার খুব একটা চোখে পড়েনি। বিএনপির প্রার্থী মো. আখতারুজ্জামান মিঞাকে অনেকটা একা একা গণসংযোগ করতে দেখা গেছে। তিনি অভিযোগ করে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, যে নেতা–কর্মী তাঁর সঙ্গে গণসংযোগে যান, তাঁকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাই তিনি ইচ্ছে করেই কোনো নেতা–কর্মীকে নিয়ে বের হননি। তবে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শনিবার চিরিরবন্দরে সমাবেশ করেছেন। সে সমাবেশে নেতা–কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল।
দিনাজপুর-৫: সমানতালে প্রচারে বিএনপি
দিনাজপুর-৫ (ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। এ আসন থেকে একটানা ছয়বারের নির্বাচিত সাংসদ তিনি। নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে তিনিসহ তাঁর দুই মেয়ে সমানতালে প্রচার চালিয়ে গেছেন। ব্যানার পোস্টারে ছেয়ে আছে দুই উপজেলা।
তবে দিনাজপুরের অন্য পাঁচটি আসনের চেয়ে ধানের শীষের জন্য অনেকটাই আলাদা ছিল এ আসন। এখানে বেশ নির্ভয়ে প্রচার প্রচার চালিয়েছেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। তবে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী এ জেড এম রেজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নেতা–কর্মীদের সব সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভয়ভীতির মধ্যে রেখেছে। সবাই আতঙ্কে রয়েছেন।
দিনাজপুর-৬: আত্মগোপনে ধানের শীষ প্রার্থী
দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-নবাবগঞ্জ-হাকিমপুর-ঘোড়াঘাট) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী জেলা জামায়াতের আমির আনোয়ারুল ইসলাম গ্রেপ্তার–আতঙ্কে প্রায় দুই মাস থেকে আত্মগোপনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি প্রচার চালিয়েছেন। তবে গণসংযোগ করতে পারেননি। চার উপজেলায় ছিল হাতে গোনা কিছু ধানের শীষের পোস্টার। তাঁর নেতা–কর্মীদের অভিযোগ, তফসিল ঘোষণার পর নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূরে আলম সিদ্দিকী, ভাইস চেয়ারম্যান শাহিনুর ইসলাম, ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি শামিম হোসেন চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনসহ প্রায় দুই শতাধিক নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতিদিনই দলের কাউকে না কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গতকাল শুক্রবারও দিনাজপুর থেকে প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট এনামুল হকসহ একজন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রায় সব নেতা–কর্মীই বাড়িছাড়া।
অন্যদিকে, নৌকার প্রার্থী সাংসদ শিবলী সাদিকের প্রচার ছিল জমজমাট। দিন–রাত চার উপজেলায় গণসংযোগ ছাড়াও ২৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নবাবগঞ্জ ও বিরামপুরের পথসভা নৌকার প্রচারে পায় নতুন মাত্রা।