বিএনপির ঘরে আগুন, একাই খেলছেন আ.লীগের দুর্জয়
একদিকে হামলা–মামলায় বিপর্যস্ত বিএনপির নেতা–কর্মীরা ঘরছাড়া, অন্যদিকে দলের দুই মনোনয়নপ্রত্যাশী এস এ জিন্নাহ কবির ও খোন্দকার আবদুল হামিদের কোন্দল গিয়ে ঠেকেছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। নির্বাচনের আর কয়েক দিন থাকলেও দলটির সমর্থকেরা জানেন না, তাঁরা কাকে ভোট দেবেন, কার পক্ষে কাজ করবেন। এই সুযোগে দলীয় নেতা–কর্মীদের নিয়ে ফাঁকা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়।
এই চিত্র শিবালয়, ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ–১ আসনের। এই আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫৮৭ জন। তাঁদের মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৯২ হাজার ৪৯৬ এবং পুরুষ ১ লাখ ৯২ হাজার ৯১ জন।
১৯৯১ সাল থেকে টানা তিনটি সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জয়লাভ করেন বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তবে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনোয়ারুল হকের কাছে তিনি হেরে যান। আর সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে দুর্জয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আফজাল হোসেন খানকে পরাজিত করেন।
এই সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা, ভোটার ও সাধারণ মানুষ বলছেন, এমনিতেই আসনটি বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত। তার ওপর গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের সাংসদদের নানা ‘বিতর্কিত কর্মকাণ্ড’ ও বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর টানা হামলা–মামলার কারণে জনসমর্থন এমনিতেই বিএনপির দিকে হেলে আছে। কিন্তু দলীয় প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এই সমর্থন হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া মামলা–হামলা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা বিএনপির কর্মী–সমর্থকদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের প্রার্থীর হয়েও কাজ করতে শুরু করেছেন।
নির্বাচন কমিশন ও বিএনপির নেতা–কর্মীদের সূত্রে জানা যায়, ৯ ডিসেম্বর সকালে একই সঙ্গে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এ জিন্নাহ কবির এবং জেলা বিএনপির সহসভাপতি খোন্দকার আবদুল হামিদকে মনোনয়নের চিঠি দেয় কেন্দ্র। সে অনুসারে তাঁরা দুজনই জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। পরের দিন জিন্নাহ কবিরকে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের জন্য জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই দিনই রিটার্নিং কর্মকর্তা জিন্নাহ কবিরকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দিলে তিনি প্রচারণার কাজ শুরু করেন। প্রচারকাজ চালানোর সময় ১৫ ডিসেম্বর দৌলতপুর উপজেলা সদরে জিন্নাহর গাড়িবহর হামলার শিকার হয়। এই অবস্থায় প্রচারকাজ চলার মধ্যেই আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী খোন্দকার আবদুল হামিদ ধানের শীষ প্রতীকে তাঁর প্রার্থিতা ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আদালত জিন্নাহ কবিরের প্রার্থিতা স্থগিত করেন এবং আবদুল হামিদকে ধানের শীষ প্রতীক ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই এই আসনে কার্যত বিএনপির নির্বাচনী কোনো কার্যক্রমই চোখে পড়েনি। এতে দলের কর্মী–সমর্থকেরাও পড়েছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে।
অবশ্য জিন্নাহ কবির বলছেন, তিনি আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আজ রোববার আপিল করতে যাচ্ছেন। আপিল নিষ্পত্তি হলে তিনি আবার মাঠে নামার পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আদালতে রিট আবেদন করার বিষয়টি দল ও আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। কারণ, শেষ পর্যন্ত আপিলের রায়ও যদি আবদুল হামিদ সাহেবের পক্ষে যায়, তাহলে তিনি নির্বাচনের তিন–চার দিন আগে প্রতীক বরাদ্দ পাবেন। তত দিনে প্রচারণার সময়ও শেষ হয়ে আসবে। এতে শেষ পর্যন্ত দলই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
অবশ্য আবদুল হামিদ দাবি করছেন, দল ও নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। আদালতের রায়ে তিনি সুবিচার পেয়েছেন। এখন তিনি প্রতীক বরাদ্দের অপেক্ষায় আছেন।
এই অবস্থায় মানিকগঞ্জের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস বলছেন, তিনি এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কিংবা উচ্চ আদালত থেকে জিন্নাহ কবিরের প্রার্থিতা বাতিলের কোনো লিখিত নির্দেশনা কিংবা আদেশ পাননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, শেষ পর্যন্ত এই আসনে কে বিএনপি থেকে নির্বাচন করবেন, কিংবা আদৌ কেউ পারবেন কি না।’
এদিকে ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই দলীয় নেতা–কর্মীদের নিয়ে এই সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাঈমুর রহমান দুর্জয়। গতকাল শনিবারও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি শিবালয় ও ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সভা করেছেন, গণসংযোগ চালিয়েছেন।
ভোটের উত্তাপ নেই
গতকাল শনিবার মানিকগঞ্জ–১ সংসদীয় আসনের ঘিওর উপজেলার সদর এলাকা, বানিয়াজুরী, কাউটিয়া, মাইলাগী ও দৌলতপুর উপজেলার কলিয়াবাজার, মান্দারতা বাজারসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে ভোটের কোনো উত্তাপ টের পাওয়া যায়নি। সাধারণ মানুষের চোখেমুখে ছিল একধরনের উদ্বেগের ছাপ। পারতপক্ষে লোকজন এক জায়গায় জড়ো হওয়া কিংবা ভোটের আলোচনা থেকেও বিরত আছেন। নৌকা বাদে অন্য প্রার্থীদের প্রতীক কিংবা পোস্টারের কোনো চিহ্ন কোথাও চোখে পড়েনি।
দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় ঘিওর বাজার এলাকার এক চা–দোকানির সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রতিদিন তাঁর দোকানে দেড় কেজির বেশি চা–পাতার প্রয়োজন হতো। কিন্তু প্রচারণা শুরুর পর এখন তা এক কেজির নিচে নেমে এসেছে। ওই চা–দোকানি বলেন, ‘এমন ভোট হইতাছে যে চায়ের দোকানেও কেউ আসতে চায় না। রাস্তাঘাটেও মানুষ ভিড় করতে ভয় পায়। বুঝেন অবস্থা!’
মান্দারতা বাজার এলাকার অশীতিপর বদর উদ্দীন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। ভোটের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভয় ও উদ্বেগ মেশানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘জীবনে ভোট তো কম দিলাম না। কিন্তু এই রহম নির্বাচন আগে দেহি নাই।’