বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর তাগিদ
ভূরাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসাসহ বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর আগ্রহ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর এ অঞ্চলের গুরুত্ব আগের চেয়ে বেড়েছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি।
গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ববিষয়ক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এমন মন্তব্য করেন।
‘কোভিড–১৯–পরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, প্রতিবেশগত ও আঞ্চলিক গুরুত্ব’ শীর্ষক ওই ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) এবং আইইউবির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি) যৌথভাবে ওই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
আলোচনায় সঞ্চালনা করেন আইইউবির বে অব বেঙ্গল ইনস্টিটিউট প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ ফেলা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে আমাদের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তার অনেকটাই আমাদের অজানা। সম্ভাবনার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের স্বার্থেই এটা আমাদের জেনে নিতে হবে। কারণ, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতি ও কৌশলগত কারণে অপার সম্ভাবনার দুয়ার আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। তাই আমাদের জ্ঞান ও তথ্যভিত্তিক গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবেই তৈরি করে নিতে হবে।’
বিআইএমআরএডি বা বিমরাডের চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল (অব.) নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের এক বিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা হচ্ছে পণ্য পরিবহন, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক সংযোগপথ। এটি ইন্দো–প্যাসিফিকের মূল অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। সমুদ্রপথে প্রভাব বিস্তারের জন্য এখানে আমরা চীন, জাপান ও আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোকে সক্রিয় হতে দেখছি। একদিকে চীন এই অঞ্চলকে মাথায় রেখে সামুদ্রিক রেশমপথ বা মেরিটাইম সিল্ক রুটের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রও ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কোভিড–১৯–পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।’
ওয়েবিনারের মূল আলোচক ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো–প্যাসিফিক, চীনের বিআরআই এবং জাপানের এফওআইপির পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরের অগ্রাধিকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমাদের স্বার্থে তহবিল, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, বাজার সুবিধা ও ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে সমান সুবিধা নিশ্চিত এবং প্রতিরক্ষা, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ও পানিসম্পদে সামর্থ্য বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হবে।’
প্যানেল আলোচকের বক্তৃতায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য একদিকে প্রতিযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আবার একে অন্যকে সহযোগিতার ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। বঙ্গোপসাগর ঘিরে বড় সুযোগ তৈরির প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে কূটনীতির। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক দর–কষাকষিতে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।’
প্যানেল আলোচকের বক্তৃতায় আইইউবির গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের প্রধান অধ্যাপক ইমতিয়াজ এ হুসাইন বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের সমন্বিতভাবে নীতি প্রণয়নে জোর দিতে হবে। আর সেই নীতিগত কৌশল হতে হবে বহুমাত্রিক।’
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর। তাই উন্নয়নের পাশাপাশি আমরা এখানে স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিচ্ছি। তাই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাই। রোহিঙ্গারা যাতে রাখাইনে ফিরে যেতে পারে, সে জন্য সেখানে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে জাপান সহযোগিতা করছে।’ বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় বিমসটেকের মহাসচিব মো. শহীদুল ইসলাম বঙ্গোপসাগরীয় সহযোগিতা জোট সাম্প্রতিক সময়ে যেসব কাজ করেছে, তা তুলে ধরেন।
আইইউবির বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান এ মতিন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর ঘিরে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সে জন্য আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’ স্বাগত বক্তৃতায় আইইউবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মিলান পাগন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তার প্রমাণ করে দিয়েছে আমরা এখন কেউই আর বিচ্ছিন্ন নই। একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। কোনো দেশের পক্ষেই বলা সম্ভব নয়, সমস্যাটা তোমার, আমার নয়।’
সমাপনী বক্তৃতায় আইইউবির বে অব বেঙ্গল ইনস্টিটিউট প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো ও সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের প্রতিবেশ ও পরিবেশগত ভূমিকা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক গুরুত্বের ওপর আরও চারটি ওয়েবিনার হবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, এসব আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের অবস্থান ঠিক করার ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে কিছু সুপারিশ পাব।’