ফাঁকি বন্ধে আঙুলের ছাপে সরকারি চাল

রাকিব হাসান
ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হন ২০১৬ সালে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫০ লাখ পরিবারকে বছরে পাঁচ মাস ১০ টাকা দরে চাল দেয় সরকার। মাসে দেওয়া হয় ৩০ কেজি করে। নজরুল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মারা যান। কিন্তু তাঁর নামে তিন বছর ধরে চাল উত্তোলন করা হয়েছে।

দেবীদ্বার উপজেলার গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের উজানীজোড়া গ্রামের মো. সবুজ, সুফিয়া খাতুন ও রাশেদা বেগম ২০১৫ সাল থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা বছরে দুবার করে চাল নিতে পেরেছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান হয়, তাতে দেখা যায়, তাঁদের নামে ইতিমধ্যে প্রতি কার্ডে ১৮ থেকে ২২ বার পর্যন্ত চাল নেওয়া হয়েছে।

চাল বিতরণে এসব অনিয়ম রুখতে দেবীদ্বারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাকিব হাসান বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকের নামে কার্ড করা হয়েছে, তাঁরা জানেন না। অথচ তাঁদের নামে বছরের পর বছর চাল তোলা হচ্ছে। ক্রমাগতভাবে যখন অভিযোগগুলো আসছিল, তখন ভাবলাম প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি ব্যবস্থা দাঁড় করাব।’

ইউএনও রাকিবের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার ফসল ‘ওএমএস দেবীদ্বার’ ওয়েবসাইট www.omsdebidwar.gov.bd। এ ওয়েবসাইটে উপকারভোগীর নাম, ঠিকানা, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, আঙুলের ছাপসহ ১৩ ধরনের তথ্য রয়েছে। এতে উপকারভোগীকে আসল-নকল যাচাই করে চাল দেওয়া হয়। একই ব্যক্তি যেন একাধিকবার চাল উত্তোলন করতে না পারেন, সেটি দেখা হয়।

ওয়েবসাইটে প্রত্যেক উপকারভোগীর তথ্যের বিপরীতে যুক্ত করা হয়েছে তাঁর আঙুলের ছাপ। উপকারভোগী তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর, ডিজিটাল আইডি নম্বর দিয়ে ব্যবস্থাটিতে (সিস্টেম) প্রবেশ করামাত্রই তাঁর ছবিসহ যাবতীয় তথ্য প্রদর্শিত হয়। সবার ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছে। যেকোনো একটি আঙুলের ছাপ দিলে, তা মিললে ‘চাল উত্তোলন সম্পন্ন হয়েছে’, এমন ধন্যবাদ বার্তা দেখায়।

শুধু তাই নয়, উপকারভোগীর চাল উত্তোলনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার বা সার্ভারেও জমা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কারা চাল উত্তোলন করেছেন, কারা করেননি, তার তথ্য জানতে পারেন। ফলে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকে না।

সরকার প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে এক দফা খাদ্যবান্ধব চাল বিতরণ করে। দেবীদ্বারের ধামতী ইউনিয়নের ধামতী গ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ দিয়ে ওই চাল বিতরণ শুরু হয়। দুপুর ১২টার দিকে ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার পাশে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমে দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, ইউএনও রাকিব হাসান ও ধামতী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

ওয়েবসাইটে ঢুকে গতকাল সন্ধ্যায় দেখা গেল, মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ৯৭৭। মজুত থাকা চালের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার কেজি। গতকাল বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫০ কেজি চাল।

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায় প্রথমবারের মতো বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে (আঙুলের ছাপ দিয়ে) ওএমএসের চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এতে একজনের কার্ডের চাল আরেকজন নিতে পারবে না। গতকাল দুপুর ১২টায় ধামতী গ্রামে
ছবি: এম সাদেক

ইউএনও রাকিব বলেন, ‘ব্যবস্থাটি তৈরির জন্য ডিলার ও উপকারভোগীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সব কটি ইউনিয়নে ব্যবস্থাটি করা হবে। পুরো উপজেলার সবাইকে এর আওতায় আনব। ওয়েবসাইট আরও হালনাগাদ করব।’

ইউএনওর এ উদ্যোগের পর যাঁরা গতকাল চাল কিনতে গিয়েছিলেন তাঁদের একজন ছালেহা বেগম বলেন, ‘এখন আর কেউ কারও চাল মেরে দিতে পারবে না।’

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘ওএমএসের চাল বিতরণে অনিয়ম ঠেকাতে এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি। একই পদ্ধতিতে সরকারের অন্যান্য সেবাও দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

সরকারি চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পুরোনো। ২০১৯-২০ অর্থবছরে খাদ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় মোট ২২ লাখ টন চাল বিতরণ করেছে। অনিয়ম রুখতে একটি ইউনিয়নে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা সব ক্ষেত্রে নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনে মনে হচ্ছে আমাদের সরবরাহে যে সমস্যা থাকে, এ ব্যবস্থায় তা অনেকাংশে কমবে। এটাকে আমরা দেশব্যাপী কাজে লাগাতে পারি।’

দেশে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ১২৫টি। এ খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী বাছাই ও ভাতা দেওয়া নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

কুমিল্লার দেবীদ্বারে চাল বিতরণে অনিয়ম রুখতে তথ্যপ্রযুক্তির যে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার করে অনিয়ম দূর করা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সম্মাননীয় (ডিস্টিংগুইশড) অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেবীদ্বারের ইউএনও যা করেছেন, দেশের প্রতিটি জায়গায় তা হওয়া দরকার। তাঁর নেওয়া এ ব্যবস্থা জাতীয়ভাবে গ্রহণ করার জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব।’