২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ফলে সফল বাংলাদেশ

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) নতুন জাতের জাম্বুরা
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) নতুন জাতের জাম্বুরা

আপনি জানেন কি—বাংলাদেশ বিশ্বে পেয়ারা উৎপাদনে সপ্তম ও আম উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে? সাম্প্রতিক সময়ে ফল উৎপাদনে দেশে উল্লেখ করার মতো সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দিন দিন এ দেশে ফলের উৎপাদন বাড়ছে অথচ ফল চাষের জমি কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, এ দেশে ২০০৮-০৯ সালে ফল চাষের জমি ছিল ৩.৬১ লাখ একর, ২০১৪-১৫ সালে তা হয় ৩.২৪ লাখ একর।
ভাবতে ভালো লাগে যে এত ছোট একটা দেশ, যার আবাদযোগ্য জমির মাত্র ১.৫ শতাংশ জমিতে ফল চাষ করা হয়, অথচ সেই স্বল্প পরিমাণ জমি থেকেই আসছে এই স্বর্ণসাফল্য, ভবিষ্যতে ফল–বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার হাতছানিও দেখা যাচ্ছে। সারা বছরই আমরা এখন আপেলের চেয়ে মজাদার ও পুষ্টিকর কচকচে মিষ্টি স্বাদের থাই পেয়ারা খাচ্ছি। দেশে বছরে প্রায় ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে থাই পেয়ারার চাষ হচ্ছে, উৎপাদন ৪ লাখ মেট্রিক টনের ওপরে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে থাই পেয়ারার এমন সম্প্রসারণ অভাবনীয়। নাটোরের থাই পেয়ারা চাষি সেলিম রেজা এখন থাই পেয়ারা চাষ করে কোটিপতি হয়েছেন। থাই পেয়ারা চাষ করে বছরে ২০-৩০ লাখ টাকা আয় করেন এমন অন্তত ১০-১২ জন চাষি রয়েছেন। ফল চাষ করে অনেক চাষি সেসব ফলের নামেই এলাকায় বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। পেঁপে বাদশা, লিচু কেতাব, কলা কাদের, কুল ময়েজ, কুল নারায়ণ, মাল্টা অমল প্রমুখ এখন এ দেশের কয়েকজন সফল ফলচাষি।

ঈশ্বরদীতে একটি পেঁপেবাগান। ছবি: প্রথম আলো
ঈশ্বরদীতে একটি পেঁপেবাগান। ছবি: প্রথম আলো

চুয়াডাঙ্গার আবুল কালাম আজাদ আম্রপালি আম চাষ করে বছরে ৭-১০ লাখ টাকা আয় করেন। চুয়াডাঙ্গার কাদের বেপারী (কলা কাদের) জৈবপ্রযুক্তিতে কলা চাষ করে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তিনি এলাকার প্রায় ১০০০টি বসতবাড়িতে রঙিন সাগরকলা চাষ করেছেন। পাবনার ঈশ্বরদী মা মণি খামারের বাদশা (পেঁপে বাদশা) পেঁপে ও শরিফা চাষ করে বছরে ৮-১০ লাখ টাকা আয় করেন। মাত্র ১.৫ বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ শুরু করে বর্তমান তাঁর পেঁপে চাষের জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ বিঘা। পেঁপে চাষের জন্য তিনি ১৪০৩ সনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারের রৌপ্যপদক পেয়েছেন এবং ১৪০৪ সনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারের স্বর্ণপদক পান। বর্তমানে পেঁপে, শরিফা, পেয়ারাসহ তিনি ৩২টি উদ্যান ফসলের বাগান গড়ে তুলেছেন।
চট্টগ্রামের কোহিনুর বেগম চিটাগাং মেরিডিয়ান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক। তিনি বান্দরবান জেলায় ৩৫০ একর জমিতে মিশ্র ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন, যা থেকে তাঁর বছরে আয় হয় প্রায় ১ কোটি টাকা। এ জন্য তিনি ১৪১৯ সনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারের রৌপ্যপদক পান। পাবনা ঈশ্বরদীর সিদ্দিকুর রহমান (কুল ময়েজ) আপেল ও বাউ জাতের কুল চাষ করে বছরে ৮-৯ লাখ টাকা আয় করেন। বর্তমানে তিনি প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ফলের বাণিজ্যিক বাগান গড়ে তুলেছেন। ফলচাষে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৪১৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারের রৌপ্যপদক ও ১৪২১ সালে স্বর্ণপদক পান। বাগেরহাট গোটাপাড়া গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র হালদার ২০০৯ সালে মাত্র ১৮টি কুলের চারা লাগিয়ে কুলবাগানের কাজ শুরু করেন। বর্তমানে ২০ একর জমিতে কুলসহ প্রায় ৭৫ একর জমিতে মিশ্র ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। পিরোজপুরে অমল গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক মাল্টাবাগান।
দেশে ফল চাষ ও ফলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে ফলের উন্নত জাত ও আধুনিক কলাকৌশল উদ্ভাবন করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আর সেসব জাত ও কলাকৌশল চাষিদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফলের মানসম্মত চারা কলম উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টারসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিগত বছরে ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে প্রায় ২৪ লাখ ফলের চারা কলম উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের প্রায় ১২ হাজার বেসরকারি নার্সারি ফলের অনেক চারা কলম তৈরি ও বিক্রি করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ফল চাষ সম্প্রসারণে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ায় দেশে দিন দিন ফলের উৎপাদন বাড়ছে। বিশেষ করে এ দেশে প্রায় ৫৩ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় বাগানের বাইরে জমি বা বসতভিটা ও তার আশপাশ থেকে। তাই দেশের প্রতিটি বাড়িতে ফলগাছ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ে ফল চাষ সম্প্রসারণ, রাস্তার ধারে খেজুর ও তালগাছ লাগানো, উপকূলীয় অঞ্চলে খাটো জাতের নারকেলের চারা রোপণ, শহরে ছাদের বাগানে ফল চাষ ইত্যাদি করা হচ্ছে।

noname
noname

এ দেশে যেসব ফল উৎপাদিত হয় তার শতকরা ৬০ ভাগ আসে জুন থেকে আগস্ট এই ৩ মাসের মধ্যে। এখন বছরের অন্য মাসগুলোতে ফল পাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। ইতিমধ্যে থাই পেয়ারা চাষে যথেষ্ট সাফল্য এসেছে। এখন দেশীয় বাউ কুল, আপেল কুল, বিভিন্ন জাতের আনারস, রঙিন জামরুল ছাড়াও বিদেশি ও উচ্চমূল্যের ফলের মধ্যে ড্রাগন ফ্রুট স্ট্রবেরি দেশের বিভিন্ন বাগানে উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত এভোকাডো, ম্যাঙ্গোস্টিন, কিউই, লংগান, রাম্বুটান, জাবাটিকাবা, সৌদি খেজুর, আলুবোখারা, লংগান বা আঁশ ফল, পিচফল ইত্যাদি ফল এ দেশে প্রবর্তন করা হলেও বাণিজ্যিক সফলতা এসেছে ড্রাগন ফ্রুট চাষে। কৃষি বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১৩২০টি প্রদর্শনী খেতে প্রায় ১২০ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের আবাদ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত জাত যেমন বারি মাল্টা-১, বাউ কুল, আপেল কুল, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট ইত্যাদি ফল বাংলাদেশে ফল চাষে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়সহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মাল্টার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। অক্টোবর-নভেম্বরে মাল্টা ফল সংগ্রহ করা যায়। যে সময়ে বাংলাদেশে ফলের স্বল্পতা থাকে। গত বছর ১ হাজার ২০৪ হেক্টর জমিতে মাল্টার আবাদ হয়েছে, যা থেকে ৫ হাজার ৪৩৪ মেট্রিক টন মাল্টা উৎপাদিত হয়েছে।
এ দেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদিত হয় তার প্রায় ৬০ শতাংশ স্থান দখল করে আছে কলা, কাঁঠাল ও আম। কলা সারা বছরই পাওয়া যায়। জাতভেদে কাঁঠাল ও আম পাওয়া যায় দুই থেকে পাঁচ মাস। আমের প্রাপ্তিকাল আরও কীভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে আমের বিভিন্ন আগাম ও নাবি জাত নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে সফলতা পাওয়া গেছে। আম্রপলি, হাঁড়িভাঙা, গৌড়মতী, বারি আম-৪, বারি আম-১০, হিমসাগর, ল্যাংড়া প্রভৃতি আমের জাত ফল–বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সুস্বাদু হিমসাগর আমকে ছড়িয়ে দিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংস্থা সলিডারিডাড নেটওয়ার্কের সহায়তায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে আম রপ্তানি শুরু করেছে।
বর্তমানে যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, কানাডা, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ দেশ থেকে বিভিন্ন ফল রপ্তানি হচ্ছে। বিশেষ করে আনারস (হানিকুইন জাত), আম, পেঁপে, লটকন, লেবু, সাতকরা, কুল, জলপাই, আমড়া প্রভৃতি ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্রমতে, এ দেশ থেকে ২০০৫-০৬ সালে ফল রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৬.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের, ২০১২-১৩ সালে ফল রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭১.৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০১২-১৩ বছরের তুলনায় ২০১৩-১৪ বছরে ফল রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ২৫.৭৭ শতাংশ। ফল উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সারা বছর ফল পাওয়া যাবে, বাণিজ্যিকভাবে ফলের চাষ ও রপ্তানি বাড়বে।

মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও লেখক।