২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

প্রতিদিন সাড়ে ১০ কোটি চায়ের কাপে চুমুক

কুঁড়েঘর থেকে বঙ্গভবন—সবখানেই সমান কদর। চায়ের নেশায় গতি পায় গত দুই দশকে

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু হয় না, এমন মানুষ আছে নাকি? ফুটপাতে টংদোকান থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেল, কুঁড়েঘর থেকে বঙ্গভবন—সবখানেই চায়ের সমান কদর। শুধুই কি সকাল? ক্লান্ত দুপুর, অলস বিকেল কিংবা সন্ধ্যার আড্ডাও জমিয়ে তোলে এক কাপ চা।

এ দেশের মানুষ প্রতিদিন কত কাপ চা পান করেন, এর হিসাব কি আমরা জানি? চা বোর্ডের হিসাবে, সেটা হবে ১০ কোটি ৪৩ লাখ কাপ চা। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক প্রায় সাড়ে ১০ কোটি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন।

বাগান থেকে কাপ পর্যন্ত পৌঁছাতে এই চা নানা পথ পাড়ি দেয়। চা–পাতায় আছে শ্রমিকের হাতের ছোঁয়া। প্রতি কাপ চায়ের জন্য ১১ গ্রাম সবুজ পাতা-কুঁড়ি তুলতে হয়। এরপর হালকা যন্ত্রের নিচেও পড়তে হয়। আবার নিলামে তোলার আগে চায়ের নমুনার স্বাদ নেয় টি টেস্টার। এভাবে আট-দশ ধাপ পেরিয়ে কাপে ওঠে চা।

প্রতি কাপ চায়ের জন্য দুই গ্রাম চা–পাতা হলো আদর্শ। তবে দুধ–চিনি মিশিয়ে অনেকের কড়া লিকারের চা পছন্দ।
শাহ মঈনুদ্দীন হাসান, সভাপতি, টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন

চা বোর্ডের হিসাবে, গত বছর সম্ভাব্য ৯ কোটি ৫২ লাখ কেজি চা ব্যবহৃত হয় দেশে। প্রতি কাপে আড়াই গ্রাম চা–পাতা হিসাবে ধরলে বছরে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি কাপ চা পান করেছেন এ দেশের মানুষ। তাতে দিনে ১০ কোটি ৪৩ লাখ কাপে চুমুক দিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষ। ২০১০ সালে ছিল ৬ কোটি ৩২ লাখ কাপ চা। দুই দশক আগে ছিল আরও কম, সোয়া ৪ কোটি।

চায়ের ধরন ও গ্রাহকের রুচির ওপর নির্ভর করে প্রতি কাপে চা দানা ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের টি অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে প্রতি কাপ চায়ের জন্য এক চামচ (দুই গ্রাম) চা–পাতা ব্যবহারের কথা বলেছে। বিপণনকারী কোম্পানিগুলো টি ব্যাগে দুই গ্রাম চা–পাতা ব্যবহার করে। টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ইস্পাহানীর মহাব্যবস্থাপক শাহ মঈনুদ্দীন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি কাপ চায়ের জন্য দুই গ্রাম চা–পাতা হলো আদর্শ। তবে দুধ–চিনি মিশিয়ে অনেকের কড়া লিকারের চা পছন্দ। সে ক্ষেত্রে প্রতি কাপে আড়াই গ্রাম চা দানা ব্যবহার করতে হয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে পণ্যের ভোগ বেড়ে যায়। চায়ের চাহিদা বাড়তে থাকার কারণও এটি। চায়ের উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়ায় অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক।

সাধারণ মানুষের এই সস্তা পানীয় একসময় ছিল অভিজাতদের। দামও ছিল বেশি। এ উপমহাদেশে চা চাষের শুরুতেও ছিল তাই। প্রায় ১০০ বছর আগে এ দেশে সাধারণ মানুষের মুখে চা তুলে দেন ইংরেজ বণিকেরা। চায়ের নেশাও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামে, গ্রাম থেকে দুর্গম এলাকায়—দেশের আনাচকানাচে চায়ের চল শুরু হয়।

তবে চায়ের নেশায় গতি পায় গত দুই দশকে। ২০০১ সালে গড়ে একজন মানুষ বছরে ১১৩ কাপ চা পান করতেন। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে ২২৯ কাপে। চা বোর্ডের হিসাবে, দেশে প্রতিবছর গড়ে চায়ের চাহিদা বাড়ছে সোয়া ৫ শতাংশ হারে। এ দেশে চা পান বাড়লেও বৈশ্বিকভাবে শীর্ষস্থানটা অন্য দেশের।

‘চা–খোর’ হিসেবে বৈশ্বিকভাবে শীর্ষস্থানটা অনেক দিন ধরেই তুরস্কের দখলে। ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটির তথ্য, তুরস্কে একজন মানুষ বছরে ৩ কেজির বেশি চা ভোগ করেন। এই ৩ কেজি দিয়ে ১ হাজার ২০০ কাপ চা তৈরি করা যায়। এর পরের অবস্থান লিবিয়া, মরক্কো, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও হংকংয়ের।

জনসংখ্যার কারণে দেশভিত্তিক মোট চা পানের শীর্ষস্থানটা চীনের দখলে। চীনারা বছরে ২০০ কোটি কেজির বেশি চা ভোগ করেন। ভারতের মানুষ ভোগ করেন ১০৩ কোটি কেজি। মোট চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ১২তম। তিন দশক আগে ছিল ১৫তম।

চায়ের চাহিদা বাড়ছে। তাতে বাজারও দিন দিন বড় হচ্ছে। এই খাতের বাজার সম্প্রসারণে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। নানা স্বাদের চা বাজারজাত করে এবং সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই খাতে যুক্ত হয়েছে মেঘনা গ্রুপও। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হাত ধরেই চায়ের বাজার বড় হচ্ছে
মোস্তফা কামাল , মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান

গত দুই দশকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চায়ের নেশা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি চোখে পড়েছে উদ্যোক্তাদের। তাই বাজার ধরতে তাঁরা এখন সক্রিয়। তাঁদের কেউ বিনিয়োগ করেছেন উৎপাদনে। কেউবা বিপণনে। তাতে উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি বাজারও বড় হচ্ছে।

উৎপাদনের কথাই ধরা যাক। গত বছর দেশে চায়ের উৎপাদন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। এ সময়ে উৎপাদন ছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি। করোনার কারণে এবার এই রেকর্ড ভাঙছে না। অক্টোবর পর্যন্ত গতবারের চেয়ে এবার ১ কোটি কেজি চা উৎপাদন কমেছে। অবশ্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৫ কোটি ও শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৩ কোটি কেজি উৎপাদন কমেছে। আফ্রিকার উগান্ডা, তানজানিয়া, মালাউতেও উৎপাদন কমেছে। মহামারি শেষে উৎপাদন যে ঘুরে দাঁড়াবে, তাতে সংশয় নেই কারও।

মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, চায়ের চাহিদা বাড়ছে। তাতে বাজারও দিন দিন বড় হচ্ছে। এই খাতের বাজার সম্প্রসারণে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। নানা স্বাদের চা বাজারজাত করে এবং সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই খাতে যুক্ত হয়েছে মেঘনা গ্রুপও। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হাত ধরেই চায়ের বাজার বড় হচ্ছে।

মহামারির চলতি সময় বাদ দিলে গত বছরের হিসাবে চায়ের বাজারের আকার বেড়েছে। বিপণন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বাজারের আকার ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। চা কিনে এই টাকা দিচ্ছেন ভোক্তারা। আর পাচ্ছে উৎপাদক থেকে বাজারজাতকারী কোম্পানি, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। বেচাকেনার ফাঁকে কর ও কমিশনে ভাগ পাচ্ছে সরকার ও ব্রোকারেজ হাউস। কিছু টাকা পাচ্ছেন শ্রমিকেরা। শ্রমিকের ভাগের অংশকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা শব্দ চয়ন করেছে ‘অতিদারিদ্র্য বিমোচন’ নামে। ঠিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির প্রথম ধাপের সঙ্গে মিল রেখেই।

লেখাটা পড়তে কতক্ষণ লাগল? বড়জোর ৫ মিনিট। ততক্ষণে কিন্তু সাড়ে ৩ লাখ মানুষ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফেলেছেন। দিন শেষে এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি। তাঁদের একজন হয়তো আপনি।