পাঁচের জায়গায় দশ বছর, স্মার্ট কার্ডের কী খবর
প্রকল্পের সময় ছয় দফা বাড়িয়েও কাজ শেষ হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। এর মধ্যে ভোটারও বেড়ে ১১ কোটি ছাড়িয়েছে।
৯ কোটি ভোটারকে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য ২০১১ সালে পাঁচ বছরের একটি প্রকল্প নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পাঁচ বছরের জায়গায় দশ বছর চলে গেছে। এখন পর্যন্ত এই কার্ড হাতে পেয়েছেন মাত্র ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ।
জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য ২০১১ সালে আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস প্রকল্প (আইডিইএ) হাতে নিয়েছিল ইসি। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল একটি নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য স্মার্ট এনআইডি সিস্টেম গড়ে তোলা। ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের সময় ছয় দফা বাড়িয়েও এই কাজ শেষ হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। এর মধ্যে ভোটারের সংখ্যাও বেড়ে ১১ কোটি ছাড়িয়েছে।
অবশ্য স্মার্ট কার্ড দিতে না পারলেও প্রায় সব ভোটারই কাগজে ছাপানো লেমিনেটেড কার্ড পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আর সময় না বাড়িয়ে গত জুন থেকে আইডিইএ ফেজ-২ নামে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির সময় অতিরিক্ত (বাই প্রোডাক্ট) হিসেবে কাগজে ছাপানো একটি পরিচয়পত্র দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু এই পরিচয়পত্র যন্ত্রে পাঠযোগ্য নয়। স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্লাস্টিক কার্ডে তৈরি, যা যন্ত্রে পাঠযোগ্য। এর সঙ্গে একটি চিপ আছে। এখানে ব্যক্তির বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা তথ্যের পাশাপাশি ১০ আঙুলের ছাপ ও আইরিশের প্রতিচ্ছবি থাকে।
৯ কোটি স্মার্ট কার্ড নেওয়ার জন্য ফ্রান্সের ওবারথার টেকনোলজিসের (বর্তমানে আইডিইএমআইএ) সঙ্গে চুক্তি করেছিল ইসি। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত ৯ কোটি ব্ল্যাংক কার্ডই (খালি কার্ড) বুঝে পায়নি ইসি। আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ইসি পৌনে ৮ কোটি ব্ল্যাংক কার্ড হাতে পেয়েছে। এর মধ্যে ৬ কোটি ৭০ লাখ কার্ড পারসোনালাইজেশন (ব্যক্তির প্রয়োজনীয় তথ্য কার্ডে অন্তর্ভুক্ত করা) করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে প্রায় ৬ কোটি ৬৫ লাখ। আর কার্ড হাতে পেয়েছেন মাত্র ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ।
ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে প্রকল্পটিতে শুরু থেকেই ছিল মন্থর গতি। পরিচয়পত্র তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২০১১ সালে ইসির চুক্তি হয়। আইডিইএ নামের ওই প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করতে দুই বছর দেরি হয়, বিশ্বব্যাংকের কিছু শর্তের কারণে। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিশ্বব্যাংক আর চুক্তি নবায়ন করেনি। অন্যদিকে এই প্রকল্পের অধীনে স্মার্ট কার্ড সরবরাহের জন্য ফ্রান্সের ওবারথার টেকনোলজিসের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ইসি। চুক্তি অনুযায়ী, ৮১৬ কোটি টাকার বিনিময়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ৯ কোটি স্মার্ট কার্ড ইসিকে দেওয়ার কথা ওবারথারের। কিন্তু তারা সেটি দিতে ব্যর্থ হয়। নির্ধারিত সময়ের পর আর চুক্তি নবায়ন করেনি ইসি। আর পাওনা না পাওয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরে ইসির বিরুদ্ধে আরবিট্রেশন মামলা করে। এসব জটিলতায় গত চার বছরে নতুন কোনো স্মার্ট কার্ডও আসেনি। যে কার্ডগুলো ইসির হাতে আছে, সেগুলোর সব বিতরণ করতে পারেনি তারা।
ইসি সূত্র জানায়, এখন ওবারথারের সঙ্গে একটি সমঝোতা হচ্ছে। সমঝোতা অনুযায়ী, ইসি ওবারথারকে ২৬ মিলিয়ন ডলার দেবে, আর বাকি কার্ডগুলো তারা ইসিকে সরবরাহ করবে।
* আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ইসি পৌনে ৮ কোটি ব্ল্যাংক কার্ড হাতে পেয়েছে। * এর মধ্যে ৬ কোটি ৭০ লাখ কার্ডে ব্যক্তির প্রয়োজনীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। * উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে প্রায় ৬ কোটি ৬৫ লাখ। * কার্ড হাতে পেয়েছেন মাত্র ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ।
জানতে চাইলে এই প্রকল্পের (ফেজ-২) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ওবারথারের সঙ্গে একটি সমঝোতা অনেকটা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এই টাকাটা দ্রুত অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পেলে আগামী তিন মাসের মধ্যে বাকি কার্ডগুলো আনার ব্যবস্থা করা যাবে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) এই কার্ড সরবরাহ করবে। প্রতিবছর ৬০ লাখ করে পাঁচ বছরে ৩ কোটি স্মার্ট কার্ড তাদের কাছ থেকে কেনা হবে।
আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের বলেন, প্রায় দুই কোটি স্মার্ট কার্ড এখন উপজেলা পর্যায়ে আছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন স্মার্ট কার্ড বিতরণ একেবারে বন্ধ ছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর পুনরায় নওগাঁর কয়েকটি উপজেলায় কার্ড বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিককে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে, এটা তাদের পরিকল্পনা।
ইসি সূত্র জানায়, স্মার্ট কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা আছে। যেমন নির্ধারিত দিনে ভোটারদের অনেকে কার্ড নিতে আসেন না, কিছু কার্ড নির্ধারিত সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না, অনেকের হাতের আঙুলের ছাপ নিতে সমস্যা হয়, নাগরিকের সব তথ্য পরিপূর্ণ না থাকার কারণে অনেক কার্ড প্রিন্ট দেওয়া সম্ভব হয় না।
দেশে প্রথম ছবিসহ ভোটার তালিকার কাজ শুরু করেছিল সামছুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। ওই কমিশনের সদস্য এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পের কার্যপ্রবাহে ধারাবাহিকতা ছিল না। মাঝখানে একটি কমিশন তেমন কোনো কাজ করেনি। আবার বিদেশি একটি কোম্পানির সঙ্গে সমস্যা তৈরি হয়েছে। মূলত প্রশাসনিক সমস্যার কারণেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।