পদ্মা সমৃদ্ধ মাছের প্রজাতিতে
পদ্মার ইলিশ জগৎখ্যাত। পদ্মাপারের জনপদে ইলিশ নিয়ে গর্বের শেষ নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মা যেদিক দিয়ে গেছে, সেসব জেলার মানুষ দাবি করেন, তাঁদের এলাকার ইলিশই সেরা।
গুগল সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজলে দেখা যায়, প্রবহমান নীল স্রোতোধারার গঙ্গা ফারাক্কা ব্যারাজে পৌঁছানোর পর হোঁচট খেয়ে হঠাৎই পদ্মা হয়ে গিয়েছে। গঙ্গা ফারাক্কা থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে পদ্মা নাম নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে। এরপর রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী হয়ে পৌঁছায় গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়া-আরিচা পর্যন্ত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে ফারাক্কার পর থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ১৮৫ কিলোমিটার।
দৌলতদিয়ায় পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয় যমুনা। নদীবিজ্ঞানীরা যমুনাকে বলেন ব্রহ্মপুত্র। দৌলতদিয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ৯৫ কিলোমিটার। পদ্মার মোট দৈর্ঘ্য ২৮০ কিলোমিটার। এরপর পদ্মা চাঁদপুরে এসে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়। মিলিত ধারা মেঘনা নাম নিয়ে সাগরে মেশে।
২০১৮ সালে পদ্মাপারের বিভিন্ন জেলার মানুষের সঙ্গে ইলিশ নিয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছিল। রাজশাহীর প্রবীণেরা বলেছিলেন, ওই এলাকার ইলিশের স্বাদের সঙ্গে অন্য এলাকার ইলিশের তুলনা করা ভুল। দৌলতদিয়া বাজার মৎস্য আড়ত সিমিতির সভাপতি মো. মোহন মণ্ডল বলেছিলেন, পদ্মার ইলিশ মানে আরিচার ইলিশ। আর সে ইলিশ পাওয়া যায় দৌলতদিয়া বাজারে। চাঁদপুরের হারুন মাঝি বলেছিলেন, ‘চাঁদপুরের ইলিশ যে খায় নাই, সে ইলিশই খায় নাই।’
কী মাছ আছে পদ্মায়
ইলিশ ছাড়াও পদ্মায় আরও অনেক ধরনের মাছ পাওয়া যায়। মাছের প্রজাতির জন্য সমৃদ্ধ পদ্মা। বহু ছোট-বড় নদী-খাল পদ্মা থেকে জন্ম নিয়েছে, মিশেছে অনেক। বড় বড় বিলের যোগ আছে পদ্মার সঙ্গে। পদ্মায় আছে মাছের ডিম ছাড়ার পরিবেশ, আর আছে খাবার। ২০১৪ সালের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) মূল্যায়ন বলছে, প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল পদ্মা। এর মধ্যে আছে কাকিলা (কাইক্কা), ফাসা, কাচকি, চাপিলা, খয়রা, রানি (বউ মাছ), পুইয়া (গুতুম), পইয়া (পুইয়া), মলা (মোয়া), পিয়লি (জয়া), মোরারি, কাতলা, মৃগেল, রাইখোর (রেবা), বাঁশপাতা, বাটা, ভাঙ্গান, কালবাউশ, নান্দিনা, রুই, চেলা, চেলা (কাটারি), ঢেলা, চোলাপুঁটি, কাঞ্চনপুঁটি, সরপুঁটি, জাতপুঁটি, ভাতপুঁটি, তিতপুঁটি, ডারকিনা (ডারকা), খরশোলা, চিতল, ফলৈ, চান্দা, লম্বা চান্দা, রাঙা চান্দা, কই, নাপিত কই, গজার, গাছুয়া (চ্যাং), টাকি, শোল, বেলে, খলিশা, চুনা খলিশা, লাল খলিশা, মেনি, ট্যাংরা, গুলসা ট্যাংরা, বাজারি ট্যাংরা, রিটা, আইড়, গইজা, চেকা, মাগুর, শিং, কাজুলি, ঘাউরা, মুরিবাচা, বাচা, কাটা বাতাসি, শিলং, কানি পাবদা, মধু পাবদা, বোয়াল, বাগাড়, চেনি, গাং ট্যাংরা, বাইম, তারা বাইম, পাকাল বাইম, গোচি, পটকা (টেপা)। এ ছাড়া আছে বেশ কয়েক প্রজাতির চিংড়ি।
মাছ ধরতে নানা ধরনের জাল
একই জাল দিয়ে সব মাছ ধরা যায় না। পদ্মায় প্রধানত পাঁচ ধরনের জাল দিয়ে জেলারা মাছ ধরেন— (১) কারেন্ট জাল (বোয়াল, আইড়, বাইম, বাটা, বাইলা, পুঁটি মাছ ধরার জন্য); (২) বেড় জাল (বোয়াল, আইড়, বাটা, কাতলা, মৃগেলসহ সব ধরনের ছোট মাছ); (৩) খেপলা জাল (পুঁটি, ইচা, ট্যাংরা, বাইলাসহ অন্যান্য ছোট মাছ); (৪) মোই জাল (বাইম, বাতাসি, টাকি, শোল, গজাল); (৫) ঠেলা জাল (পুঁটি, ট্যাংরা, গুলসা, ইচা)। এ ছাড়া ভেসাল, ঝাকি, টোইরা, খোরা ও ছটকা জালের ব্যবহারও আছে।
যেসব জায়গায় স্রোত, সেখানে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়। স্বচ্ছ পানিতে মাছ ধরতে কোচ এবং কম পানিতে পলোর ব্যবহারও আছে। আর আছে ইলিশ ধরার জাল।
জেলেরা মাছ ধরতে কোন জাল ব্যবহার করবেন, তা নির্ভর করে পানির গভীরতা ও স্রোতের তীব্রতার ওপর। তবে খেপলা জাল সারা বছর ব্যবহার করা হয়।
অতিমাত্রায় মাছ ধরা, পরিবেশদূষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রজননক্ষেত্রের বিলুপ্তি, পানিপ্রবাহে বাধা, নদী ভরাট হওয়া—এসব কারণে পদ্মায় মাছ কমে যাচ্ছে। পদ্মায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে বা মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সরকারের উদ্যোগ নেই বললেই চলে।