মামুন মিয়া সন্তানের নাম দিয়েছিলেন বৈশাখ। কাওসার হোসেন বৈশাখ। মাত্র সাত বছর বয়স হয়েছিল তার। সেদিন, পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনের দিন বাবার দোকানে পুড়ে মারা যায় সে। এই ঘটনায় ১২৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল মামুনের ছেলে, আদরের সন্তান।
ঘটনা কী ঘটেছিল, তা গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানান মামুন। বলেন, তাপ থেকে বাঁচতে দোকানের শাটার নামিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই বুঝলেন, আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। একপর্যায়ে দগ্ধ শরীর নিয়ে নিজে কোনোরকমে বের হতে পারলেও ছেলেকে আর ফিরে পাননি।
নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর কেটে গেছে ১১ বছর। মামুন এখন ফলের ব্যবসা করেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনি শুধু সন্তানকেই হারাননি, ঋণে জর্জরিত হন। তাঁর মাথা, কান, হাতসহ শরীরের ডান পাশে পোড়ার চিহ্ন রয়ে গেছে। সেই চিহ্ন দেখিয়ে তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় আগুনে মানুষের মৃত্যু তো বন্ধ হয়নি, বিচারও হয়নি।
নিমতলীর আগুনের ঘটনা ঘটেছিল ২০১০ সালের ৩ জুন। আজ বৃহস্পতিবার এ ঘটনার ১১ বছর পূর্ণ হলো। এরপর পুরান ঢাকায় আরও দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মৃত্যু হয় আরও ৭৭ জনের। কিন্তু পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা সরেনি। এমনকি সরানোর প্রকল্পে বড় কোনো অগ্রগতিও নেই। ওদিকে নিমতলীর ঘটনায় বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল। পুলিশ সেটির তদন্তই করেনি।
বংশাল থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় কোনো মামলা বা জিডি হয়েছিল কি না, তা আমার জানা নেই। আমি গত ২৭ এপ্রিল এই থানায় যোগদান করেছি।’
নিমতলীতে সেদিনের আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল ৪৩ নবাব কাটারার পাঁচতলা ভবনের নিচতলা থেকে। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ভবনগুলোয়। সেই পাঁচতলা ভবনে এখন একতলা বাড়ানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটিতে এখন আর রাসায়নিকের গুদাম নেই। মালিকেরা সেই ভবনেই থাকেন। তবে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
নবাব কাটারার আগুনলাগা ভবনটির নিচতলায় রহিম স্টোর নামের একটি মুদিদোকান চালান শফিকুল ইসলাম। তাঁর ভাই দোকানটি চালাতেন। তবে ১১ বছর আগের আগুনের ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। শফিকুল বলেন, এত মানুষ মারা গেল, তবু কোনো বিচার হলো না।
নিমতলীতে ১২৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় আগুনলাগা ভবনটির সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে। সেটির ডান পাশেই নবাব কাটারা সমাজকল্যাণ সংগঠন ও পঞ্চায়েতের একটি ছাউনি। সেখানে বসে গল্প করছিলেন স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। ঘটনার সময় তিনি পাশের একটি মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন। তিনি বলেন, মসজিদ থেকে বেরিয়ে তিনি দেখেন চারপাশের অন্তত ১২টি ভবন জ্বলছে। চারদিকে মানুষের চিৎকার, হুড়োহুড়ি ও আহাজারি।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এমন আগুন কখনো আমরা দেখিনি। আর দেখতেও চাই না।’
নিমতলীর আগুনের ঘটনার পর পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামের ছাড়পত্রের অনুমতি দেওয়া বন্ধ রেখেছে ফায়ার সার্ভিস। তবে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামগুলো এখনো আছে। এসব গুদামের মালামাল আনা-নেওয়া করা হয় অনেকটা গোপনে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (অপারেশন) আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, মাঝরাতের দিকে এসব গুদামে মালামাল ওঠানো-নামানো হয়।
পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম কত, তার সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব বা তথ্য নেই। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় করা সরকারি এক জরিপ বলছে, সেখানে রাসায়নিক ব্যবসার ১ হাজার ৯২৪টি পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, পুরান ঢাকায় দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের প্রায় ১৫ হাজার গুদাম আছে।
রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, আরমানিটোলা, ইমামগঞ্জ, ইসলামবাগ, মিটফোর্ড, হাজারীবাগ ও কোতোয়ালিতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অসংখ্য রাসায়নিকের গুদাম। তাঁরা গুদাম স্থানান্তরের সিদ্ধান্তে রাজি আছেন। তবে এ বিষয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঘাটতি সরকারেরই।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছর আগে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের যে ব্যবসা ছিল, তা অন্তত ২০ গুণ বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা অতিদ্রুত রাসায়নিক পল্লিতে যেতে চান। সরকারের কাছে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওই পল্লির মাটি ভরাট, বরাদ্দ এবং দ্রুত স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের এক হিসাব বলছে, পুরান ঢাকায় অন্তত ৩৭ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবসা হয়, যা দাহ্য। এগুলোতে আগুন লাগলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে গুদামে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবসা চলছে। সেখানেই ব্যবসায়ীরা কেনাবেচা করছেন। কোনো নিরাপত্তাবিধি মানছেন না।
আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, পুরান ঢাকায় কোনো আগুনের ঘটনা ঘটলেই সবাই বিস্ফোরক পরিদপ্তরকে দোষ দেন। অথচ সেখানে রাসায়নিক ব্যবসার ছাড়পত্র দেয় সরকারের আরও ১২টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো তদারকির জন্য ১২টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে কী করা যায়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
নিমতলীর আগুনে সন্তান বৈশাখকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন ফল বিক্রেতা মামুন মিয়ার স্ত্রী। সংসারের অভাব–অনটনের মধ্যেও শুধু স্ত্রীর ছেলে হারানোর বেদনা দূর করতে আরেকটি সন্তান নিয়েছেন মামুন। নাম রেখেছেন শ্রাবণ, তার বয়সও এখন সাত।
নিমতলীতে নিজের ফলের দোকানে ভেতরে টাঙানো সন্তানের ছবি দেখিয়ে মামুন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, শ্রাবণ দেখতে হুবহু বৈশাখের মতো। মহল্লায় সবাই তাকে বৈশাখ নামেই ডাকে। ছলছল চোখে মামুন আরও বলেন, ‘বৈশাখ বেঁচে থাকলে এখন ১৮ বছরের তরুণ হতো। আমাদের মতো কারও বুক যেন খালি না হয়।’