না বুঝে 'না' ভোট, সংসদে বিতর্ক...
বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব প্রত্যাহারের বিষয়টি বুঝতে না পেরে প্রথমে ‘না’ ভোট দিলেন সরকারি দলের সাংসদেরা। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বিষয়টি বুঝতে পেরে সাংসদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে আবার ভোটে দিলেন। দ্বিতীয় দফায় বেশির ভাগ সদস্য ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলেন। আর এর মধ্য দিয়ে সরকারি দলের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর একটি বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হতে হতে হলো না।
পরে একই বিষয়ে দুইবার ভোট নেওয়া নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়। পয়েন্ট অব অর্ডারে সাবের হোসেন বলেন, দুইবার ভোটের কোনো নজির নেই। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে বিভক্তি ভোট দেওয়া যেত। এই একটা ভোটেতো সরকারের পতন হয়ে যাবে না।
সাবের হোসেনের বক্তব্য সমর্থন করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, পদ্ধতিগত যে প্রশ্ন উঠেছে, এটা খুব খারাপ দৃষ্টান্ত হলো। যদি সংসদ সদস্যরা জাতীয় স্বার্থে কথা বলতে না পারেন, এভাবে যদি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়, পদ্ধতিগত প্রশ্ন ওঠে তা হতাশার।
এই দুই জ্যেষ্ঠ সাংসদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সংসদের অভিমত (ভোটের ফল) নিয়ে প্রথমে তিনি বিভ্রান্ত (কনফিউজড) ছিলেন। যে কারণে দ্বিতীয়বার ভোট দিয়েছেন। এই এখতিয়ার স্পিকারের আছে। এ ধরনের নজিরও আছে। সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে স্পিকারের বক্তব্যকে সমর্থন জানান। স্পিকার আরও বলেন, এখানে পক্ষপাতিত্বের কোনো বিষয় নেই। রাশেদ খান মেননের কিছু বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হোক, এ ধরনের কোনো কিছুই এই হাউসে করা হয় না।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এই ঘটনা ঘটে। তামাকজাত দ্রব্যের ওপর প্রচলিত অ্যাড-ভেলোরাম (স্তরভিত্তিক মূল্যের শতকরা হার) পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ করার দাবি জানিয়ে বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব এনেছিলেন সরকারি দলের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী। সংশোধনী দিয়ে তাঁর এই প্রস্তাবে সমর্থন জানান আরও ৯ জন সাংসদ।
সাবের হোসেন চৌধুরী তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে বলেন, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশে তামাকের যে কর-কাঠামো তা অত্যন্ত জটিল, পুরোনো ও অকার্যকর। বিশ্বের মাত্র ছয়টি দেশে এভাবে করারোপ করা হয়। অন্যদিকে ফিলিপাইন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশির ভাগ দেশে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি চালু আছে। এটি করা হলে রাজস্ব আয় বাড়বে।
জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বর্তমান আইনে তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের সুযোগ নেই। চলমান বাজেটে স্তরভিত্তিক শুল্কারোপ করা হয়েছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ক্রমান্বয়ে সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতি চালু করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো একদিন এটি হবে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণত সরকারি দলের সাংসদেরা তাঁদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু সাবের হোসেন চৌধুরী তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। তখন নিয়ম অনুযায়ী তাঁর প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের জন্য কণ্ঠভোটে দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সংসদের অভিমত এই যে, সকল প্রকার তামাকজাত দ্রব্যের ওপর প্রচলিত অ্যাড-ভেলোরাম পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ করা হউক।’ স্পিকার ভোটে বলেন, ‘সাবের হোসেন চৌধুরীর এই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হোক, যাঁরা এর পক্ষে আছেন তাঁরা “হ্যাঁ” বলুন।’ খুব কমসংখ্যক সদস্য হ্যাঁ বলেন। স্পিকার বলেন, ‘যাঁরা এর বিপক্ষে আছেন তাঁরা “না” বলুন।’ বেশিরভাগ সদস্য ‘না’ বলেন। অর্থাৎ বেশিরভাগ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়ে দেন। এ সময় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে হাসতে দেখা যায়। পরে তিনি বলেন, তিনি আবার সব সদস্যের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। তিনি প্রস্তাবটি আবার পড়ে শোনান এবং দ্বিতীয় দফা ভোটে দেন। দ্বিতীয় দফায় ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হয়। এতে সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়।
কণ্ঠভোটের পরপরই সাবের হোসেন চৌধুরী ফ্লোর চেয়েছিলেন। তখন তাঁকে ফ্লোর দেওয়া হয়নি। পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে তিনি কথা বলেন। সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমি হতাশ আমরা যখন জনস্বার্থে একটা কথা বলি আমরা সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কথা বলি, সেখানে মাননীয় মন্ত্রী সেটাকে গ্রহণ করলেন না। অর্থাৎ তাঁর অবস্থান হচ্ছে তামাক কোম্পানি যেন বেশি আয় করতে পারে, সরকারি আয় যাতে না বাড়ে উনি এটার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।’
সাবের হোসেন প্রশ্ন রাখেন, একই বিষয়ে দুইবার ভোট হতে পারে কি না। বেসরকারি সদস্যরা যে প্রস্তাব আনেন সেটা তাদের অধিকার। এখানে কোনো হুইপিং নেই। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় যেভাবে হাত দেখিয়ে ভোট পাল্টাবে, এই নজির সংসদে রাখা উচিত নয়। সাবের হোসেন বলেন, তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বিভক্তি ভোট চাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘এই একটা ভোটেতো সরকারের পতন হয়ে যাবে না। আমাদের সবার মাঝে সেনসেটিভিটি এত বেশি হয়ে যায় এটাতো সরকারের বিপক্ষে ভোট না। এটা জনস্বার্থের পক্ষে একটা ভোট। সে উদারতা আমাদের মননীয় মন্ত্রীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। এবং জাতীয় স্বার্থেই তারা এ ধরনের আচরণ করবেন বলে আশা করি।’
সাবের হোসেন চৌধুরী সংসদের কার্যবিবরণী দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, তাতে যদি প্রমাণ হয় যে, তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তা যেন সংসদের অভিমত হিসেবে গণ্য করা হয়।
এরপর পয়েন্ট অর্ডারে রাশেদ খান মেনন বলেন, বেসরকারি সদস্য দিবস সদস্যদের বিশেষ অধিকার। যেগুলো তাঁরা জরুরি মনে করেন সেগুলো নিয়ে আসে। সংসদে নজির আছে বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব থেকে। এই ভোটের সময় তিনি তাঁর কক্ষে ছিলেন উল্লেখ করে মেনন বলেন, ‘টেলিভিশনে দেখছিলাম আপনার (স্পিকার) একজন কর্মকর্তা কি যেন বললেন, তারপর আবার ভোটে দিলেন।’