বেসরকারি পর্যায়ে মজুত
দেশে চালের মজুতের হিসাবে বড় ফারাক
খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাবে চালের মজুত ৬ লাখ টন। তবে বিআইডিএস–ইফপ্রির সমীক্ষা বলছে, এপ্রিলে চাল থাকে ৭১ লাখ টনের বেশি।
দেশে গত জানুয়ারিতে যখন চালের দাম বাড়ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চালের মজুত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, দেশে বেসরকারি খাতে ৫ লাখ ১৬ হাজার টন চাল ও ৭ লাখ ২৭ হাজার টন ধান রয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের চলতি মাসের প্রতিবেদনে বেসরকারি পর্যায়ে চালের মজুতের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন দেখানো হয়েছে। কিন্তু দেশে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিলে চালের মজুত কি এতটাই কমে আসে? বাজারে প্রতি মাসে প্রায় ২৫ লাখ টন চাল কেনাবেচা হয়। বেসরকারি পর্যায়ে চালের মজুত যদি ৭-৮ লাখ টন হয়, তাহলে বাকি চাল কোথা থেকে আসে, এই প্রশ্ন রয়েই যায়।
বিআইডিএস ও ইফপ্রির হিসাব আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। ব্যবসায়ীরা মূলত সরকারি মজুত কম থাকার সুযোগ নিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন।
বেসরকারি পর্যায়ে চালের মজুত নিয়ে সরকারি হিসাবের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতির বড় ফারাকের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) এক সমীক্ষায়। এতে বলা হয়েছে, সাধারণত জানুয়ারিতে বেসরকারি পর্যায়ে চালের মজুত থাকে প্রায় ৭১ লাখ টন। এপ্রিলে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৮২ হাজার টনে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বেসরকারি পর্যায়ে চাল মজুতের যে হিসাব দেওয়া হয়, তা সরকারকে খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল বার্তা দিচ্ছে। কারণ, বড় ও মাঝারি কৃষক এবং চালের আড়তদার ও ফড়িয়াদের কাছে থাকা ধান-চাল তাদের হিসাবে আসে না। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো ফরমে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা সঠিক তথ্য দিচ্ছেন কি না তা যাচাইয়ের মতো জনবলও খাদ্য অধিদপ্তরের নেই।
নির্দিষ্ট ফরমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাল মজুতের হিসাব নেয় খাদ্য অধিদপ্তর। ব্যবসায়ীরা সঠিক তথ্য দেন কি না, তা যাচাইয়ের ব্যবস্থা নেই।
সাবেক এই কৃষিসচিব বলেন, ‘বিআইডিএস ও ইফপ্রির হিসাব আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। ব্যবসায়ীরা মূলত সরকারি মজুত কম থাকার সুযোগ নিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন।’
বেসরকারি খাতে চালের মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে গত বছর একটি সমীক্ষা করে বিআইডিএস ও ইফপ্রি। সমীক্ষার শিরোনাম ‘একটি কার্যকর খাদ্যবিষয়ক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে বেসরকারি খাতে চালের মজুতের হিসাব করার পদ্ধতি’। এই সমীক্ষাটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রকাশ করা হয়নি। সমীক্ষায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি খাতে চালের মজুত পর্যালোচনা করা হয়। তবে সমীক্ষায় আমদানি করা চাল অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কারণ, ওই দুই বছর দেশে তেমন চাল আমদানি হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সালে সংশোধিত খাদ্য মজুত আইন অনুযায়ী দেশের সব চালকল, চালের পাইকারি ব্যবসায়ী ও ধানের গুদামমালিকের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট ফরমের মাধ্যমে তাঁরা মজুতের হিসাব নেন।
বিআইডিএস ও ইফপ্রির সমীক্ষায় দেখা যায়, সাধারণত দেশে চালের মজুত সবচেয়ে কম থাকে মার্চ ও এপ্রিলে। তবে এপ্রিলে হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু হলে মজুত বেড়ে যায়। কোনো মাসেই চালের মজুত ৫০ লাখ টনের নিচে নামে না। অবশ্য মজুতের হিসাব যা-ই হোক, করোনাকালে অত্যন্ত চড়া দামে চাল কিনতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। বাজারে এখনো মোটা চালের কেজি ৪৬-৫০ টাকা, যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্য অধিদপ্তর যেভাবে বেসরকারি মজুতের তথ্য সংগ্রহ করে, তাতে সব মজুতের হিসাব না-ও আসতে পারে।’