দুবাইয়ের বাঙালি নায়ক
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্দাটা মানুষের বানানো সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা বুর্জ খলিফার দেয়ালে। প্রায় ১ কিলোমিটার উঁচু এই বিল্ডিংয়ের এক পাশ পুরোটাই একটা টিভির পর্দা। এই পর্দায় এ বছর এপ্রিলের ১৫ তারিখে ভেসে উঠল আমাদের চাঁদপুরের মো. মোশাররফ হোসেনের ছবি। আরও এক বছর আগে যখন সারা পৃথিবী কোভিড-১৯-এর অতিমারিতে ঘরবন্দী, মোশাররফ তখন দুবাইয়ের পথে পথে শহরটা জীবাণুমুক্ত করছিলেন। মরুদেশ আরব আমিরাতের গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পায়ের তলা থেকে মাথা অবধি সুরক্ষা আবরণে নিজেকে ঢেকে অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাতেই তাঁর এই স্বীকৃতি। তিনি অতিমারির সম্মুখসারির যোদ্ধা, একজন সম্মুখসারির নায়ক। তবে এই স্বীকৃতি শুধু মোশাররফের নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ১ কোটি ২৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকেরও।
মোশাররফের সঙ্গে কথা বললে আপনি বুঝবেন, তিনি ওই সোয়া এক কোটি মানুষের প্রতিনিধি। দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রতিনিধি, যাঁরা শুধু দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রাই আনেন না, পৃথিবীটাকে সবার জন্য আরেকটু বাসযোগ্য করতে উদয়াস্ত খেটে যান। তাই মোশাররফ যখন ঝাঁ-চকচকে শহর দুবাইয়ে সম্মানিত হন, সে সময় একই সঙ্গে গর্বিত হন তাঁর দুই রুমমেট, তাঁরই চাকরিস্থল পেস্ট কন্ট্রোল দুবাইয়ের সহকর্মী, আশপাশের পরিচিত বাঙালি, ওই শহরের অপরিচিত বাঙালি—সবাই।
মো. মোশাররফ হোসেন
প্রবাসী শ্রমিক
জন্ম
১০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩
ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
দুবাই গমন
২৮ আগস্ট ২০০৩
দুবাই পৌরসভায় যোগদান
১ মে ২০০৬
বিশেষ কোভিড দায়িত্ব
২৮ মার্চ–২ জুন ২০২০
বুর্জ খলিফায় ছবি প্রদর্শন
১৬ এপ্রিল ২০২১
অর্জন
সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্মুখসারির নায়কের স্বীকৃতি
আপনি যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের গ্রুপগুলোতে খোঁজেন, দেখবেন বিশ্বজুড়ে সব প্রবাসী শ্রমিক আনন্দিত তাঁর অর্জনে। এ জন্যই ‘ফ্রন্টলাইন হিরোস ইউএই’ নামের ফেসবুক পেজে যখন বুর্জ খলিফায় মোশাররফের ছবি প্রদর্শনের ভিডিও আপলোড হয়, সেখানে ‘ভালোবাসি বাংলাদেশ’, ‘গর্বিত বাঙালি’ বা বাংলাদেশের পতাকার কমেন্টই সবচেয়ে বেশি।
মোশাররফ হোসেনের জন্ম ১৯৮৭ সালে, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানায়। পড়াশোনা করেছেন নিজের গ্রামে, তারপর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ সরকারি কলেজে। বিকম পড়ছিলেন। এ সময় আরও প্রায় এক কোটি বাঙালির মতো জীবনের টানে ২০০৩ সালের ২৮ আগস্ট তাঁকে পাড়ি জমাতে হয় দুবাইয়ে। পাঁচ ভাই, দুই বোনের বড় পরিবারের হাল ধরতে তাঁকে বিদেশ নিয়ে যান তাঁরই বড় ভাই। তিন বছর নানা কাজ করার পর ২০০৬ সালের মে মাসের ১ তারিখ যোগ দেন দুবাই পৌরসভার কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ বিভাগে। যাকে তাঁরা সংক্ষেপে ডাকেন ‘আমাদের ডিপার্ট’। সেখানে তাঁদের যুদ্ধটা মশা-মাছি-ইঁদুর-সাপদের বিরুদ্ধে, শহরকে স্বাস্থ্যকর রাখতে দিনভর মোশাররফের কাজ ঘুরে বেড়ানো, কোথায় পোকামাকড় বাসা বাঁধছে, খুঁজে বের করে প্রয়োজনে সেগুলো নির্মূল করতে কীটনাশক নিয়ে মাঠে যান তিনি। এভাবেই চলছিল ২০২০ সালের মার্চের ২৮ তারিখ পর্যন্ত।
মার্চের ২৮ তারিখে শুরু হয় কোভিড মোকাবিলায় তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব। তখন লকডাউন চলছে। জরুরি সেবা ছাড়া প্রায় সবই বন্ধ। চারদিকে আতঙ্ক, করোনা নিয়ে খুব একটা কিছু কেউ জানে না। এর মধ্যেই সবকিছু ঝটপট হতে লাগল। তাঁদের অফিসে নতুন সব প্রটোকল এল, কীটনাশক ছিটানোর যন্ত্রপাতি তো আগেই ছিল, এর সঙ্গে যুক্ত হলো আরও কিছু সুরক্ষা পোশাক। নতুন ধরনের রাসায়নিক এল, এল বিশাল ড্রোন, যে ড্রোনের আবার সহকারী ছোট ড্রোনও আছে।
দুবাইয়ের লকডাউন মানে কারফিউ। কারফিউটা বেশির ভাগ সময় ছিল রাতে। তাই অনেক সময় সন্ধ্যায় শুরু হতো মোশাররফদের কর্মযজ্ঞ। তাঁরা সুরক্ষা পোশাকে আবৃত হয়ে জীবাণু ধ্বংসের রাসায়নিক বানান। এরপর গাড়িতে, ড্রোনে বা পিঠের ট্যাংকে করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত জীবাণুনাশক ছিটান। যেখানে মানুষের হাত দেয়, কোনোভাবে সংস্পর্শে আসে, সেগুলোই তাঁদের মূল লক্ষ্য।
দুবাইতে সে সময় তাপমাত্রা কখনো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছোঁয়, এই গরমেই মোশাররফ বন্দী থাকেন সুরক্ষা পোশাকে। রোজা চলছে। তিনি রোজা রাখেন। সূর্যাস্ত হলে রাস্তার পাশেই কোথাও বসে সবাই মিলে কোনো রকমে ইফতার করেন, তারপর আবার কাজে লেগে যান। কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন প্রায় ১৫ বছর, প্রতিদিন কাজ করতে হয় সাড়ে সাত ঘণ্টা। কিন্তু করোনাকালে কোনো কোনো দিন ১৬ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়। কাজের শুরুর সময়ের কোনো ঠিক নেই, শেষেরও ঠিক নেই। যখনই ডাক আসে, প্রস্তুত হয়ে চলে যান।
মোশাররফ থাকেন সরকারি কোয়ার্টারে। এক রুমে তিনজন, যাঁদের একজন তাঁরই বড় ভাই। কোয়ার্টারে এমন করেই থাকেন শত শত শ্রমিক। তাঁদের অনেকেই করোনার সময় জরুরি সেবায় কাজ করেন। সবচেয়ে বড় ভয় তখন নিজে করোনা আক্রান্ত হন কি না। দেশে পরিবার দুশ্চিন্তায়, নিজেও দুশ্চিন্তায় থাকেন। দুশ্চিন্তা শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, আশপাশে কেউ আক্রান্ত হলে নিজেকেও সঙ্গনিরোধে যেতে হবে। তাঁদের বিভাগের ৬০-৭০ জন শুরুতে এই জীবাণুমুক্ত করতে জরুরি সেবায় যুক্ত হয়েছিলেন, অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, অনেককে আক্রান্তের সংস্পর্শে এসে সঙ্গনিরোধে যেতে হয়েছেন। এভাবে কমতে কমতে একসময় এই কাজে মোশাররফদের সঙ্গী ছিল বিশেরও কম। তাই যতই দিন গেছে, তাঁদের কাজের চাপ বেড়েছে।
২৪ এপ্রিল এমনই কাজের চাপে ১৬ ঘণ্টা বাইরে থাকতে হলো। দিনটা বিশেষ, কারণ সেদিনই তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্ম। প্রবাসী হিসেবে তিনি অনেক আগে থেকেই জানেন, এমন সময় স্ত্রীর পাশে থাকতে পারবেন না। তবে প্রযুক্তির যুগে হাজার মাইল দূরে সংযুক্ত তো থাকতে পারেন। কিন্তু দিনভর দুশ্চিন্তার মধ্যেই অদেখা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে গেলেন। মনে মনে দোয়া করতে লাগলেন স্ত্রী এবং সংসারের নতুন মুখের জন্য। সেদিন রাত দশটায় কন্যাসন্তানের বাবা হন মোশাররফ। তখন তিনি কাজে ছিলেন। সন্তানের জন্ম হয়েছে জানার পরও তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৪ ঘণ্টা, পরদিন সন্ধ্যার পর ভিডিওকলে প্রথম দেখতে পান তাঁর ফুটফুটে মেয়েকে।
পরে যখন গালফ নিউজ এই ঘটনার কথা জানতে চায়, মোশাররফের উপলব্ধিটা ছিল মনে ধরার মতো, ‘আমাকে এই দেশ অনেক দিয়েছে। ওই সময়ে দুবাইয়ের আমাকে দরকার ছিল। তাই আমি আমার কাজটা করে গিয়েছি।’
দুই মাস পরে কোভিড পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এল। তত দিনে অনেক কিছুই বোঝা গেল, কীভাবে কোভিড মোকাবিলা করা যায়,কিছুটা শিখে গেল মানুষ। মোশাররফের জরুরি সেবাও শেষ হলো। জুনের ২৮ তারিখ তিনি আবারও ফিরে এলেন কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ বিভাগে, আগের কাজে। যেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন আজ ১৬ বছর ধরে।
মোশাররফের কাছে জানতে চাই, ১৬ বছর একই কাজে থাকলেন কীভাবে? তাঁর উত্তর, ‘নিজের কাজটা করে গেছি।’
মোশাররফ যে করোনার শুরুতে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেছিলেন দুই মাস, এত দিনে তা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। এরপর গত বছর ডিসেম্বরে একদিন জানলেন, দুবাই সরকারের সম্মুখসারির যোদ্ধাদের সম্মানিত করার জন্য খোঁজখবর নিচ্ছে। পরে এ বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি শুনলেন, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিংয়ে নাকি তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। তখনই জানলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাত সম্মুখসারির নায়কের সঙ্গে একজন বাংলাদেশি প্রবাসীকেও নির্বাচিত করা হয়েছে সম্মান জানাতে, আর সেই প্রবাসী মানুষটা তিনি।
দুবাই মিডিয়া আরও খোঁজখবর নিল, গালফ নিউজ, আরব নিউজ, খালিজ টাইমস তাঁকে নিয়ে ফিচার প্রকাশ করল। আবুধাবির ৬৫ তলা এডনক বিল্ডিংয়ের দেয়ালেও দেখানো হলো তাঁর ছবি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের নানা শহরে বিলবোর্ডে তাঁর ছবি টাঙানো হলো, বাস-ট্যাক্সির গায়ে ঝুলল তাঁর ছবি।
প্রায় তিন মাস মোশাররফের ছবি ছিল নানা জায়গায়। সেসব বাস-ট্যাক্সিতে উঠে বাংলাদেশিদের গর্ব হয়। পরিচিত অনেকে তাঁকে ছবি তুলে পাঠান। তাঁর এসব ভালো লাগে। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাইলাম, নিজের বিশাল ছবিওয়ালা বাসে বা ট্যাক্সিতে আপনার চড়তে কেমন লেগেছে? অনুভূতিটা জানা গেল না, কারণ তাঁর নিজের ওই বাসে বা ট্যাক্সিতে চড়ার সুযোগ হয়নি।
আরব আমিরাতে এখন বাংলাদেশের প্রবাসী আছেন প্রায় ১৩ লাখ। লাখ লাখ শ্রমিকের মধ্যে মোশাররফ একটু আলাদা হয়ে ওঠেন। কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, না, তিনি আলাদা হয়ে ওঠেননি। তিনি তাঁদেরই একজন, তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করেন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিংয়ের দেয়ালে।
মোশাররফের কাছে জানতে চাই, ভবিষ্যতে কী করতে চান? তাঁর স্বপ্নটা অনেক বড় না। কিন্তু উত্তরটা কোটি প্রবাসী শ্রমিকের স্বপ্নকেই প্রতিনিধিত্ব করে। বাড়ি যাবেন, নতুন সন্তানকে কোলে নেবেন।
এই লেখা যখন লিখছি, তখনো মোশাররফ তাঁর মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহাকে দেখেছেন শুধু ভিডিওকলেই। অক্টোবরের শেষে তাঁর দেশে যাওয়ার কথা, তাই পাঠক, আপনি যখন লেখাটা পড়ছেন, ১৮ মাসের মুনতাহা সে সময় হয়তো মোশাররফের কোলে।
মোশাররফের চেষ্টা, দেশে থিতু হওয়ার মতো কোনো একটা ব্যবস্থা করবেন, যাতে সব সময় স্ত্রী-সন্তানদের কাছেই থাকতে পারেন। এখনো দেশে থিতু হওয়ার ব্যবস্থা হয়নি, তাই আবারও ফিরে যাবেন দুবাইয়ে।
ইবরাহিম মুদ্দাসসের: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিংয়ের পিএইচডি গবেষক