দুই পক্ষের অনড় অবস্থানে পরিস্থিতি আরও জটিল

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রোববার সন্ধ্যায় উপাচার্যের বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন তাঁরা
ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনরত শিক্ষার্থীদের প্রায় সবার শরীরে জ্বর। নেতিয়ে পড়া শরীরে ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না তাঁরা। এমন শারীরিক অবস্থার মধ্যেও এ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে অনড় তাঁরা। ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বেশ কয়েকজন অনশনকারী।

আবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনাতেও সংকট উত্তরণের আভাস পাওয়া যায়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোববার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা চলার মধ্যেই ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একাংশের আমরণ অনশন পঞ্চম দিনে পড়েছে রোববার। অন্যান্য দিনের মতোই এদিনও এক দফা দাবিতে অনড় ছিলেন অনশনকারীরা। তাঁরা বলেছেন, শারীরিক অবস্থা যা-ই হোক, উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত এ কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন তাঁরা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ১১ দিন ধরেই উত্তাল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়। আন্দোলনের প্রথম ছয় দিনে দাবি পূরণ না হওয়ায় গত বুধবার বেলা তিনটা থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আমরণ অনশনে বসেছেন ২৪ শিক্ষার্থী। তাঁদের একজনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়ি চলে গেছেন তিনি। অসুস্থ হয়ে ১৬ জন এখন হাসপাতালে ভর্তি। অপর ৭ জনের শরীরে স্যালাইন পুশ করেছেন চিকিৎসকেরা। এ ৭ জনের শারীরিক অবস্থাও দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।

দাবি পূরণ হওয়ার লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় গত শনিবার রাত আটটা থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আরেক অংশ শুরু করেছে গণ-অনশন। নতুন এই কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ রোববার আরও বেড়েছে।

উপাচার্যের বাসভবনের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ রোববার সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের বাসভবনের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী শেখ প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে শিক্ষার্থীরা এক সংবাদ সম্মেলন করে দ্রুত পদত্যাগ না করলে উপাচার্যের বাসভবনের জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। এরপর শিক্ষার্থীরা বাসভবনের সামনে মানবশৃঙ্খল তৈরি করেন। এখন থেকে পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া কাউকেই উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্নের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। শনিবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে নিন্দা জানিয়ে বলা হয়, আন্দোলনের যৌক্তিক সমাধানের জন্য যখন আলোচনা চলছে, সেই অবস্থায় এমন কার্যক্রম অন্য কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আন্দোলনের নামে এ ধরনের ‘অমানবিক’ কর্মকাণ্ডকে কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারে না।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, পাঁচ দিন ধরে তাঁরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আমরণ অনশন করছেন। এই সময়ের মধ্যে বাসভবনে নির্বিঘ্নে লোকজন যাতায়াত করেছেন। তবে এখন থেকে তাঁরা এটা চলতে দেবেন না। মানবশৃঙ্খলের মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা হবে।

এক শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করে যাব, আর তিনি (উপাচার্য) ভেতরে বসে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যাবেন, তা হতে দেওয়া হবে না।’ তাঁদের আন্দোলন অহিংস। কিন্তু বাধ্য হয়েই জরুরি পরিষেবা বন্ধের বিষয়ে ঘোষণা দিতে হয়েছে। আমরণ অনশনে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে চলে যাচ্ছেন। তবু তাঁরা অনশনে আছেন।

শিক্ষার্থীরা এ সময় জানান, চলমান সংকট নিরসনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে শনিবার দিবাগত রাতে তাঁদের ভার্চ্যুয়াল বৈঠক হয়েছে। তিনি উপাচার্যের পদত্যাগ প্রসঙ্গে স্পষ্ট কোনো কথা দেননি। বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী অনশন ভেঙে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে তাঁরা অনশন চালিয়ে রেখে আলোচনা করতে চান। মাঝরাতের ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রোববার দুপুরে আরেক দফা বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।

এ বৈঠকে তাঁদের সুস্পষ্ট কিছু অভিযোগ ও দাবি লিখিতভাবে উপস্থাপন করতে বলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। সে অনুযায়ী তাঁরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। শিক্ষামন্ত্রী যখনই ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে বসতে চাইবেন, তখনই আলোচনা হবে।

তবে রোববার রাত আটটা পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফার বৈঠকটি হয়নি।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী শাবিপ্রবিতে এসে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সংহতি জানিয়ে রোববার দুপুরে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগ চেয়ে মানববন্ধন করেছেন।

ইতিমধ্যে শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটা বিবৃতি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন শাবিপ্রবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক একটি আন্দোলন। কেউ যদি নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এটি ব্যবহার করতে চায় ও সহিংসতায় জড়ায়, তবে সেটির দায় তাঁরা নেবেন না।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাত সাড়ে নয়টার দিকে মশাল মি‌ছিল করে উপাচার্যের কুশপুত্ত‌লিকা দাহ করেছেন কয়েক শ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ‌্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনে থেকে এ মি‌ছিল শুরু হয়ে উপাচার্যের বাসভবন, গোলচত্বর, প্রক্টর কার্যালয় ঘুরে মুক্তমঞ্চে গিয়ে তা শেষ হয়।

বিবৃতি-প্রতিবাদ, প্রতীকী অনশন

শাবিপ্রবির পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সংকট সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। রোববার দুপুরে এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান তাঁরা। এর আগে গত শুক্রবার রাতে তাঁরা ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করেন। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিন দফা দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রোববারের বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ১০৫ জন সাবেক নেতার নাম উল্লেখ আছে।

সিলেটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে রোববার দুপুরে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট চলমান সংকটে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বৃহত্তর স্বার্থে চলমান সংকট দ্রুত নিরসন করা জরুরি। অনশনকারীদের জীবনের ঝুঁকি এড়াতেও দ্রুত সরকারের উচ্চপর্যায়ের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

প্রতিবেদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানান, শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে প্রতীকী অনশন কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। এটি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশের সংগঠন। শিক্ষক নেটওয়ার্কের ব্যানারে সোমবার দুপুর ১২টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতীকী অনশন হবে।

প্রসঙ্গত, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ১৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে ও তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।