করোনা রোগীকে প্লাজমা দেওয়ার বিষয়টি তখনো অনেকের অজানা। মানুষজনও এ ব্যাপারে সচেতন ছিল না। ওই সময়ে প্লাজমা প্রয়োজন হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক সমিরুল ইসলামের। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। সেই দুঃসময়ে এই চিকিৎসকের জন্য প্লাজমা জোগাড় করে দেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। ওই চিকিৎসক করোনার কাছে হেরে গেলেও এখন পর্যন্ত ২৫ জন রোগীর প্লাজমার ব্যবস্থা করেছেন নগরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন।
শুধু প্লাজমা জোগাড় করে দেওয়া নয়, আরও নানা সেবা তিনি করেছেন। কখনো টেলিমেডিসিন সেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন রোগীকে, কখনো অসুস্থ রোগীকে গভীর রাতে পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রধান কাজ হলেও করোনায় ভূমিকা রেখেছেন নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে। সংক্রমিত হবেন জেনেও নগরবাসীকে ঘরে রেখে নিজে থেকেছিলেন রাস্তায়।
নগরের কাজীর দেউড়ি এলাকায় করোনাভাইরাসে মারা যান মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রফিক। সৌদি আরব থেকে ফেরা সেকান্দর হোসেন নগরের এনায়েত বাজার এলাকার বাসায় করোনায় মারা যান। এঁদের স্বজনেরা কেউ কাছে আসেননি। কোতোয়ালি থানা-পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়। পরে পুলিশের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা লাশ দাফন করেন।
করোনায় আক্রান্ত মানুষের আতঙ্ককে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষ বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে বাড়তি দামে ওষুধ কিনেছেন। কিন্তু মানুষ যাতে ন্যায্য মূল্যে ওষুধ কিনতে পারে, সে উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। ‘আমার ফার্মেসি’ নামে তারা এ সেবা কার্যক্রম চালু করে।
করোনার শুরুতেই চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের চেম্বারে তালা ঝুলতে শুরু করে। কোনো ডাক্তারই পাওয়া যাচ্ছিল না। তখনই মোহাম্মদ মহসীন ১০ জন ডাক্তারের সমন্বয়ে চট্টগ্রামে শুরু করেন টেলিমেডিসিন সেবা ‘হ্যালো ডাক্তার’। সুনির্দিষ্ট একটি নম্বরে ফোন করেই চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন চট্টগ্রামবাসী। চট্টগ্রামে এটিই ছিল প্রথম টেলিমেডিসিন সেবা।
করোনাঝুঁকি এড়াতে লোকজন যাতে ঘর থেকে বের না হয়, সে জন্য থানায় ফোন করা হলে বাসায় বাজারও পৌঁছে দেয় পুলিশ। করোনা রোগী ছাড়া প্রসূতিকেও হাসপাতালে গভীর রাতে পৌঁছে দেয় পুলিশ নিজের গাড়িতে করে। মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে এবং বাইরে জমায়েত বন্ধে করকে দেশে প্রথমবারের মতো ড্রোন উড়িয়ে লকডাউন কার্যকর করে ওসি মহসীনের কোতোয়ালি থানা। লকডাউনের সময় সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে অযথা ঘোরাঘুরি করায় ছয়জনকে আটকও করা হয়।
সড়কে জীবাণুনাশক ছিটানো, দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং, বিনোদন কেন্দ্রে জমায়েত ঠেকানো, করোনা রোগী এবং সম্মুখযোদ্ধাদের সঙ্গে বাড়িওয়ালাদের বিমাতাসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, রোগীদের জন্য ফলমূল ভর্তি ভালোবাসার বাক্সসহ নানা পদক্ষেপ নেন পুলিশ কর্মকর্তা মহসীন।
২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ছয়জন সদস্য মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ৬৬৯ জন। সুস্থ হয়েছেন ৬২৭ জন। হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন পুলিশের আরও ৩৬ জন সদস্য।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে জনকল্যাণকর ভূমিকার কারণে পুলিশ প্রশংসা পেয়েছে। সেটি ধরে রাখতে চাই।’
করোনাকালে তিন মাস বাসায় যাননি ওসি মহসীন। মুঠোফোনের স্ক্রিনে দেখেছেন মা, স্ত্রী আর সন্তানদের ছবি। একসময় তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হন। তা জয় করে আবার নেমে পড়েন মাঠে। কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো লড়াই চলছে। করোনার প্রথম দিকের মতো এখনো মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী সাড়া দিচ্ছি। মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করছি। প্লাজমা লাগলে ব্যবস্থা করছি। বিনা মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবাও দিচ্ছি। যাতে পুলিশ সত্যিকার অর্থে মানুষের বন্ধু হতে পারে।’
● গাজী ফিরোজ: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবদেক, চট্টগ্রাম