বাংলাদেশের ২০২১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা দায়মুক্তি ভোগ করে। বিচার বিভাগেও দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটছে। আদতে সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়।
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে মানবাধিকার প্রতিবেদন-২০২১ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবছর ১৯৮টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এই বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে দেশটি। বুধবার ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের এ প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও ন্যায্য।
এ প্রতিবেদনে গত বছরের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে দেওয়া বিবরণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নাগরিকদের প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণ, রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার এবং অন্য দেশে অবস্থানরত ব্যক্তির ওপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর বেআইনি হস্তক্ষেপ, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেওয়া, বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ, সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা ও হুমকি, অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার বা বিচারের মুখোমুখি করা; ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর হস্তক্ষেপ, সংগঠন, তহবিল বা বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সংগঠনের ওপর বিধিনিষেধমূলক আইনের বিষয়টিও এসেছে।
এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, ‘আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হব, সে সম্পর্কে সততার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতি শুরু হয় তথ্য দিয়ে।’
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, মার্কিন প্রতিবেদনে তথ্যবিভ্রাট ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘২০২১-এ যে পরিমাণ গুম-খুনের কথা এখানে বলা হচ্ছে, আমাদের রেকর্ডে সে পরিমাণ নেই। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা যদি কেউ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন, নিরাপত্তা বাহিনী আত্মরক্ষায় যদি গুলিও করে; প্রতিটি ঘটনায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন। এতে যদি ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়, তাহলেই আমরা সেই বিষয়টি ক্লোজ করে দিই। আর যদি ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন এখানে ঘটনাটি অন্যায় বা অসতর্কতায় হয়েছে, সেটা আমরা বিচার বিভাগে পাঠিয়ে দিই।’
দায়মুক্তি ব্যাপক সংকট তৈরি করছে
মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিপীড়ন ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি ভোগ করে আসছে বলে খবর রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিপীড়ন, হত্যা ও দুর্নীতির খুব কমসংখ্যক ঘটনাতেই তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ খতিয়ে দেখার দায়িত্ব যে ইউনিটের, সেটি পুলিশ মহাপরিদর্শকের অধীনে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ইউনিটের ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান। অল্প যে কটি ঘটনার সুরাহা হয়েছে, সেখানেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিধিবহির্ভূতভাবে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের পর অনেক সময় যে জায়গা থেকে ব্যক্তিকে আটক করা হয়, সেই জায়গায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর বলা হয়, আত্মরক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি ছুড়ছে। ঘটছে গুমের মতো ঘটনাও।
যাকে খুশি তাকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে, বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল বা ভিন্নমতাবলম্বীদের। আইন অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক কর্মকর্তার কাছে আটক ব্যক্তিকে উপস্থাপনের কথা, সেটা সব ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় নাগরিক সংগঠন, দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর দায়মুক্তি ব্যাপক সংকট তৈরি করছে। যে পদ্ধতিতে অভিযোগের সুরাহা করার চেষ্টা করছে, তাতে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।
মার্কিন প্রতিবেদনে দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইনে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিচার বিভাগকেও আপস করতে হচ্ছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন যাঁরা, তাঁরা বলছেন, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ নেন। অনেক বিচারক রাজনৈতিক আনুগত্য থেকে রুল দেন। সরকারের পছন্দসই রায় না দিলে বিচারকদের বদলির ঘটনা ঘটছে। দুর্নীতি ও বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত কখনো কখনো এমন ব্যক্তিদের দণ্ড দিচ্ছেন, যাঁদের পক্ষে আদালতে প্রতিনিধি উপস্থাপন করা কঠিন। এমন একটি ঘটনায় হাইকোর্ট শিশুদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা না করার আদেশ দেন।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি তদন্তের প্রতি সরকারের বৈরী মনোভাব, বৈষম্য ও সামাজিক হয়রানি ও শ্রমিক অধিকারের ব্যাপারে মন্তব্য করা হয়েছে।
তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এ পর্যবেক্ষণ ‘একেবারেই অন্যায্য’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তিনি বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এটি একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মতো। তারা এমনভাবে কথাগুলো বলছে, যেন এ দেশে কোনো আইনকানুন নেই।
দায়মুক্তির অভিযোগ নাকচ
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বুধবার তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দায়মুক্তির প্রসঙ্গটি মোটেই ঠিক নয়। আবারও বলব, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর আমরা কিন্তু এই ডকুমেন্টগুলো দিয়েছি। আমরা পরিষ্কারভাবে গত তিন বছরে কতজন পুলিশ, কতজন র্যাবের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা তাদের দিয়েছি। কাজেই সেটা শুধু দু-একজন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে নয়। অথচ এ প্রতিবেদনে বলা আছে দু-একটি ক্ষেত্রে। যখন ১৭০ বা ১৯০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তখন সেটা নিশ্চয় দু-একটির সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, মার্কিন প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ শুরু করেছে। আগামী রোববার এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমে জানানো হবে।
বাধা স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিতে
বাংলাদেশের ছাপা ও অনলাইন পত্রিকাগুলো এখনো সক্রিয়, কিন্তু সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশের মাশুল গুনতে হয়েছে সাংবাদিকদের। গত বছরের ১৭ মে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গ্রেপ্তার হন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে মারা যান। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কারাগার থেকে মুক্তি পান কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ফটোসাংবাদিক আবুল কালাম, খুলনা গেজেট ও দৈনিক লোকসমাজ-এর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।
শুধু সংবাদপত্র নয়, বাংলাদেশে জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়েও বাধার মুখে পড়ছেন অনেকে। বাউলশিল্পী রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। সংবাদ প্রকাশ করায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে সাবেক একজন সাংসদ ২০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছেন।
বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিধিবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার ও সহিংসতার খবর পাওয়া যায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে। পরে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক কারণে মামলা ও গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ টানা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়, দুর্নীতি ও তহবিল তছরুপের দায়ে ২০১৮ সালে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনজীবীদের অভিমত, খালেদাকে দোষী সাব্যস্ত করার মতো উপাদান এই মামলায় ছিল না, বরং তাঁকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখার কৌশল ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতার অভাব এখনো তীব্র। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়েছিল স্বাধীনভাবে দুর্নীতি দমনের জন্য। কিন্তু ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অন্যায় রাজনৈতিক প্রভাব এ প্রতিষ্ঠানকেও আক্রান্ত করেছে। সরকারপন্থী রাজনীতিবিদ ও আমলাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে এখনো সরকারের অনুমতির জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার এখন ক্ষমতাসীনদের মর্জির ওপর নির্ভর করছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বদলে তাঁরা এখন আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। যখন যার বিরুদ্ধে প্রয়োজন, তখন তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে।