করোনায় আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনীতিতেও স্থবিরতা তৈরি করেছে। আগামী দুই মাসে সেই স্থবিরতা আস্তে আস্তে কাটাতে চাইছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। এ জন্য দলের বিভিন্ন স্তরে শূন্য পদগুলো পূরণ করার পরিকল্পনা করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। এ ছাড়া করোনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকাণ্ডে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ফলে সরকারের মন্ত্রিসভায়ও রদবদলের সম্ভাবনার কথা দলের নেতাদের আলোচনায় স্থান পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওই বৈঠক থেকেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদারের নির্দেশ আসতে পারে। এরপর মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনা আছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও সাহারা খাতুন এবং নির্বাহী সদস্য বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান মারা গেছেন। এ ছাড়া গত অক্টোবরে হওয়া আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে যে কমিটি হয়েছে, এতে আগে থেকেই চারটি পদ ফাঁকা ছিল। এখন তিনজন সদস্য মারা যাওয়ায় সব মিলিয়ে সাতটি পদ ফাঁকা হয়েছে। অনেকগুলো জেলা কমিটি ও কয়েকটি সহযোগী সংগঠনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকনির্ভর কমিটি হয়েছে। কিন্তু এখনো সেগুলো পূর্ণাঙ্গ হয়নি।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা
দলের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, করোনার কারণে হয়তো শিগগিরই সভা-সমাবেশ করার সুযোগ হবে না। কিন্তু রাজনীতির মাঠে তৎপরতা বাড়াতে তাই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মারা যাওয়ায় এই মন্ত্রণালয়ে নতুন কাউকে নিয়োগ দিতে হবে। করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে দলে, দলের বাইরে সর্বত্রই ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, সমালোচনা হয়েছে। এমনকি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে। এই নেতা বলেন, মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনা আছে।
দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত রোববার গণভবনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক হয়। সেখানে পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি সমসাময়িক অন্য বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খানও ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপনির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি ওই বৈঠকে করোনা, বন্যা পরিস্থিতি ও সাংগঠনিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সাংগঠনিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করার লক্ষ্যে আরও বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফলে সামনের দিনগুলোয় সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়বে। তবে পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতিও নজরে রাখা হবে।
অপূর্ণাঙ্গ কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনা আছে।
গত বছর ২০-২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কয়েক দফায় বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। তবে ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক এবং দুটি নির্বাহী সদস্যের পদ এখনো ফাঁকা রয়েছে।
আওয়ামী লীগে রদবদল হলেও সভাপতিমণ্ডলী থেকে গত সম্মেলনে একজনও বাদ যাননি। বরং আগে থেকে ফাঁকা থাকা পদে শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান নতুন যুক্ত হন। সম্প্রতি মোহাম্মদ নাসিম ও সাহারা খাতুন মারা যাওয়ায় দুটি পদ আবার শূন্য হলো।
দলীয় সূত্র বলছে, সভাপতিমণ্ডলীর দুটি পদ সম্পাদকমণ্ডলী ও নির্বাহী সদস্যদের থেকে পূরণ করার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষ করে চারজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে কারও কারও সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। এর বাইরে মন্ত্রিসভার দু-একজন সদস্যের নাম নিয়েও আলোচনা আছে। জাতীয় চার নেতার পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা আছে বলে আলোচনা রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন প্রয়াত ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। সর্বশেষ সম্মেলনে এ পদটিতে কাউকে রাখা হয়নি। ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন-এমন কাউকে খুঁজছে দল। অন্যদিকে শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক পদে কোনো ব্যবসায়ীর স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সেপ্টেম্বরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হতে পারে। সেখানে হয়তো সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
মন্ত্রিসভার রদবদল নিয়ে দলীয় প্রধান কিছু বলেননি। তবে এটা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি প্রয়োজন অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নেবেন।
মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনা
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত বছর ৬ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। যাঁদের মধ্যে ২৭ জনই প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় স্থান পান।
এই মন্ত্রিসভায় প্রথম পরিবর্তন হয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে চার মাসের মাথায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে। এরপর ১২ জুলাই ইমরান আহমেদকে প্রতিমন্ত্রী থেকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী এবং ফজিলাতুন নেসাকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে গণপূর্তের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। মৎস্য প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খানকে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী করা হয়।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশি আলোচিত। এ ছাড়া বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো মন্ত্রণালয়েও পরিবর্তনের আভাস আছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের সময় অন্য দু-একটা মন্ত্রণালয়ে সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিসভার রদবদল নিয়ে দলীয় প্রধান কিছু বলেননি। তবে এটা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি প্রয়োজন অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নেবেন।