দরিদ্রতম ৪৯% শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম: ইউনিসেফ
সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র গোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি অনেক বেশি। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ তাদের সর্বশেষ বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৯ শতাংশ খর্বকায়। অর্থাৎ এদের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম।
ইউনিসেফের ২০১৯ সালের শিশুবিষয়ক বার্ষিক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে গত মঙ্গলবার। ওই প্রতিবেদন বলছে, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪৭ লাখ। এদের মধ্যে প্রায় ১ লাখ শিশু স্থূলকায়। এদের ওজন বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের শিশু পুষ্টি ও শিশুস্বাস্থ্যের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে ইউনিসেফ বলেছে, শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত ঝুঁকির মধ্যে আছে। বন্যা ও নদীভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে বহু মানুষ শহরের বস্তিতে আশ্রয় নেয়। বস্তির শিশুদের অপুষ্টি, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, নির্যাতন, সহিংসতার ঝুঁকি বেশি।
প্রতিবেদনে খাদ্য ও পুষ্টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২৫৮ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী তিনটি শিশুর একটি অপুষ্টিতে ভুগছে। এসব শিশু খর্ব অথবা কৃশ অথবা স্থূল। বিশ্বের দুটি শিশুর একটি সুপ্ত ক্ষুধার শিকার, এদের ভিটামিন ও অন্যান্য অনুপুষ্টিকণার ঘাটতি আছে।
প্রতিবেদনের শুরুতে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা এইচ ফোর বলেছেন, ভালো পুষ্টি সুন্দর জীবনের সুযোগ করে দেয়। পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার কমছে। ১৯৯০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৪৪। অর্থাৎ ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৪৪টি শিশু মারা যেত। ২০১৮ সালে এই হার কমে ৩০-এ দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে এই বয়সী প্রায় ৮৯ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে ৫০ হাজার ছিল নবজাতক। অর্থাৎ জন্মের পর ২৮ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। নবজাতক মৃত্যুহার হাজারে ১৭। অন্যদিকে শিশুমৃত্যুর ৫৭ শতাংশ আসলে নবজাতকের মৃত্যু।
>ইউনিসেফের বৈশ্বিক প্রতিবেদন
বিশ্বায়ন, নগরায়ণ, বৈষম্যের কারণে বিশ্বের শিশুদের পুষ্টিঝুঁকি বেড়েছে
বাংলাদেশের শিশুরা এর বাইরে নয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ নবজাতক মৃত্যুহার কাঙ্ক্ষিত হারে কমাতে পারছে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি ও নবজাতক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে জন্ম নেওয়া অনেক নবজাতক জন্মকালীন শ্বাসজটিলতা ও পরবর্তী সংক্রমণে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পায় না। অনেকেই অত্যাবশ্যকীয় নবজাতক সেবার আওতার বাইরে। অন্যদিকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বহু শিশুকে শালদুধ খাওয়ানো হচ্ছে না। নবজাতক রোগাক্রান্ত হলে অনেক মা-বাবা তাকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিচ্ছেন না। এসবই নবজাতক মৃত্যুতে ভূমিকা রাখছে।
প্রতিবেদনে দেশের শিশু পুষ্টির করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, দেশে ২৮ শতাংশ শিশু প্রয়োজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মায়। জন্মের পরপর ৫১ শতাংশ শিশুকে শালদুধ খাওয়ানো হয়। ৪৯ শতাংশ শিশুকে ঠিক সময়ে শালদুধ দেওয়া হচ্ছে না। ছয় মাসের কম বয়সী ৫৫ শতাংশ শিশু শুধু বুকের দুধ খায়। অর্থাৎ এই বয়সী শিশুদের ৪৫ শতাংশ শিশু পুষ্টিসমৃদ্ধ এই খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসবই শিশুমৃত্যুতে ভূমিকা রাখছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বায়ন, নগরায়ণ, বৈষম্য, মানবিক সংকট—এসবই শিশু পুষ্টিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশ্বায়ন খাদ্য পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয় এমন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ৭৭ শতাংশ তৈরি করে মাত্র ১০০টি প্রতিষ্ঠান।