বান্দরবান সদরের রাজার মাঠ এলাকায় নিশ্বাস দূরত্বে নৌকা এবং ধানের শীষের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়। দুই জোটের দুই প্রার্থীর বাড়িও একই স্থানে, প্রায় ৫০ গজ ব্যবধানে অবস্থিত। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাড়ি ও নির্বাচনী কার্যালয় কাছাকাছি হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে সদরের সম্প্রীতির এই চিত্র দক্ষিণ বান্দরবানে দেখা যায়নি। বিএনপির ভোট ব্যাংক খ্যাত ওই এলাকায় একের পর এক মামলা এবং হামলার ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সাত উপজেলা নিয়ে গঠিত বান্দরবান আসনটি ৩০০তম। এই আসনের ভোটার ২ লাখ ৪৬ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে দক্ষিণ বান্দরবান অর্থাৎ লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় রয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ভোটার। সদর উপজেলার ভোটার ৬০ হাজারের বেশি। আসনটির মোট ভোটারের প্রায় ৫৫ শতাংশ বাঙালি। দক্ষিণ বান্দরবানের তিন উপজেলায় তাদের অবস্থান বেশি। আর বাঙালিদেরই প্রধান ভোট ব্যাংক মনে করছে বিএনপি।
এসব এলাকায় গত এক সপ্তাহ পুলিশ দমন–নিপীড়ন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপি প্রার্থী সাচিং প্রু জেরীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সদরে কোনো সমস্যা নেই। সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে নির্বাচনী কাজ চালিয়ে আসছিলাম। কিন্তু দক্ষিণ বান্দরবানে গত এক সপ্তাহে একের পর এক বিএনপির নেতা-কর্মীদের মামলা দিচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন। মামলার পরপরই নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে পুলিশ। আমার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ওসমান গণিকেও মামলার আসামি করা হয়েছে।’
জেরীর এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে বান্দরবান, থানচি, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম এই পাঁচটি থানায় ১৯ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় আটটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার সব আসামিই বিএনপির নেতা-কর্মী। বাঙালি অধ্যুষিত লামা উপজেলার মোট ভোটার ৬৬ হাজারের বেশি। সেখানে হয়েছে তিনটি মামলা।
বান্দরবানের সহকারী পুলিশ সুপার (লামা সার্কেল) আবু সালাম চৌধুরী বলেন, তিনি মামলাগুলোর বিষয়ে কিছুই জানেন না। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কিছু জানাননি তাঁকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপি প্রার্থী জেরী বেশির ভাগ সময় দিচ্ছেন দক্ষিণ বান্দরবানে। দক্ষিণের এই তিন উপজেলা ছাড়াও থানচি ও রুমায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। আর টানা পাঁচবারের সাংসদ বীর বাহাদুর উশৈসিং গত মঙ্গলবার সদর উপজেলার ডলুপাড়ায় প্রচারণায় যান। সেখানে পাহাড়ি নারীরা তাঁকে ফুল এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে স্বাগত জানান।
গতকাল বুধবার সদর উপজেলার গলাচিপা এলাকায় প্রচারণা চালান ধানের শীষের প্রার্থী। সদরে বীর বাহাদুরের পক্ষেও প্রচারণা চালান দলীয় নেতা-কর্মীরা। এসব প্রচারণায় বারবার সামনে চলে আসছে বান্দরবানের সম্প্রীতির বিষয়টি। দল দুটির কর্মী-সমর্থকেরা মুখেও উচ্চারিত হচ্ছে সম্প্রীতির কথা।
গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে সাচিং প্রু জেরী বলেছেন, সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয়। রাঙামাটি–খাগড়াছড়ি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু বান্দরবানে একটা সম্প্রীতি আছে। মামলা দিয়ে এটা যাতে নষ্ট করা না হয়।
সম্প্রীতির সুর খুঁজে পাওয়া যায় সদরের রাজার মাঠে গেলে। সেখানে পাশাপাশি দুই পক্ষের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে দুই প্রতীকের পক্ষে কাজ চলছে। মাঝেমধ্যে প্রচারণাও চলছে।
নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও এখনো কেউ কাউকে কোনো ধরনের কটূক্তি করেননি। ঘটেনি কোনো হিংসাত্মক ঘটনাও। দুই ক্যাম্পেই প্রচুর নেতা-কর্মীর অবস্থান দেখা গেছে। পাশে বীর বাহাদুরের বাড়ি। আবার বিএনপি প্রার্থীর পৈতৃক বাড়িও একই স্থানে। যদিও তিনি সেখানে থাকেন না।
এলাকায় আলোচনা আছে, একসময় বীর বাহাদুরকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাচিং প্রু জেরী। বীর বাহাদুরও প্রকাশ্যে দলের বর্ধিত সভায় বলেছেন, তাঁর রাজনীতিতে জেরীর অবদান রয়েছে। তিনি তাঁকে পথ দেখিয়েছেন। তবে জেরী ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে বীর বাহাদুরের কাছে হেরেছেন। এবারও গুরু–শিষ্যের লড়াই। এবারের লড়াইয়ের ফলাফল কী হয় তা দেখতে মুখিয়ে আছেন ভোটাররা।
এই আসনে জেএসএসের ভোট রয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার। তারাও কোন পক্ষে যায় সেটাও দেখার বিষয়। তবে জেএসএস সভাপতি উছোমং মারমা বলেন, ‘আমরা নেতা-কর্মীদের বলে দিয়েছি যার যেখানে ইচ্ছা ভোট দিতে। কোনো পছন্দ নেই। তবে সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই আমরা।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইসলাম বেবী বলেন, বান্দরবানে এক হাত দূরত্বে দুই নির্বাচনী কার্যালয়। একটা ঢিলও পড়েনি কারও ক্যাম্পে। এমন সম্প্রীতি সারা দেশের উদাহরণ। তবু কেন সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। উৎসবমুখর পরিবেশ রয়েছে।