ঢাকায় ক্যাসিনো আছে জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ
রাজধানীতে ক্যাসিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারে ২০১৭ সালের জুনে। পরের বছরের মার্চে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একটি সাধারণ ডায়েরি করে পল্টন থানায়। তারপরও ক্যাসিনোগুলো বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। পুলিশেরই একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, ক্যাসিনোগুলো চলছিল রাজনীতিক ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৮ জুন জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন উপসচিব তাহমিনা বেগম পুলিশ সদর দপ্তরকে ক্যাসিনো–সম্পর্কিত একটি অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠান। অভিযোগটি করেছিলেন মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লা এলাকার বাসিন্দা মোবারক খান। চিঠিতে তিনি লেখেন, একটি অসাধু চক্র কয়েক মাস ধরে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব, ধানমন্ডি ক্লাব, সৈনিক ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, এজাজ ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব ও পুরানা পল্টনে অবস্থিত জামান টাওয়ারে (১৪ তলায়) দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনো চালাচ্ছে। এসব ক্যাসিনোয় অবৈধ মাদক বিক্রি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, সদর দপ্তর যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
তদন্ত করে পুলিশ কী আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে, সে সম্পর্কে সদর দপ্তর নিশ্চিত করতে পারেনি। দিনভর চেষ্টা করেও ঢাকা মহানগর পুলিশের কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিকেলে পুলিশের বিশেষ অপরাধ সভায় নতুন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ক্যাসিনো–কাণ্ডে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
সে সময় ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ছিলেন আছাদুজ্জামান মিয়া। ১৩ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। বর্তমানে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। গতকাল রাতে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি ক্যাসিনোর ক-ও জানতাম না। আমি জানলে কি ব্যবস্থা নিতাম না? নিশ্চয়ই নিতাম।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দপ্তরের কোনো চিঠি কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযান সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি। মতিঝিল থানার ১০০ গজের মধ্যে খেলার ক্লাবে ক্যাসিনো চলছিল, অথচ পুলিশ জানতে পারেনি, এটা পুলিশের ব্যর্থতা কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে তিনি তথ্য পেতেন মূলত পুলিশের কাছ থেকে। পুলিশ তথ্য না দিলে তিনি সংবাদমাধ্যম, গোয়েন্দা সংস্থা ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে তথ্য পান। কেউই তাঁকে অবহিত করেননি বলে দাবি করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রগুলো বলছে, অপরাধ জগতে ‘পুলিশ-রাজনীতিক-সাংবাদিক’ একটি দুষ্ট চক্র আছে। এই চক্রের কারণে কখনো অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সূত্রগুলো বলছে, ক্যাসিনো পরিচালনাকারীরা ছিলেন মূলত যুবলীগের নেতা। তাঁরা শুধু টাকাপয়সা দিয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে রাখেননি, সপরিবার বিদেশে বেড়ানো, বিদেশে চিকিৎসা করানোর খরচও দিয়েছেন।
কখনোই কি অভিযান হয়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে একজন কর্মকর্তা বলেন, সকালে ক্যাসিনোয় তালা দিয়ে এসেছেন, বিকেলে মিটমাট হয়ে গেছে। আবার ক্যাসিনো খুলে গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক ও বর্তমান অন্তত চারজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম এসেছে এই অভিযানের পর। এখন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। জানা গেছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম যেন কিছুতেই প্রকাশ না পায়, সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। অনেকে বলছেন, মামলার তদন্ত র্যাবই করুক। আবার কারও কারও ধারণা, আসামি হস্তান্তরের আগেই র্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করে ফাইল বানিয়ে রেখেছে।
২০১৮ সালে আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ অবৈধ ক্যাসিনো সম্পর্কে জেনেছিল। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রীতম-জামান টাওয়ারের ১৩-১৪ তলার ক্যাসিনোতে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান শেষে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতিঝিল সার্কেলের পরিদর্শক মুহম্মদ সাজেদুল ইসলাম পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই ডায়েরিতে তিনি উল্লেখ করেন, তাঁদের কাছে তথ্য ছিল প্রীতম-জামান টাওয়ারের ১৩-১৪ তলার রেস্তোরাঁয় অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা ও সেবন করা হয়। এই তথ্যের ভিত্তিতে গত বছরের ২০ মার্চ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, অধিদপ্তরে নিয়োজিত চার পুলিশ সদস্য ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ২০ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল রেস্তোরাঁ ঘেরাও করে। কিন্তু সিসি ক্যামেরায় তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে রেস্তোরাঁ থেকে লোকজন গোপন সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে যান। পরে তাঁরা ভেতরে ঢুকে ৯০ জনকে আটক করেন। ঘটনাস্থল থেকে মদ-বিয়ার, ফেনসিডিল, সিসা সেবনের হুক্কা ও সিসার উপকরণ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এই মাদকদ্রব্যের সঙ্গে কারা জড়িত বা কার সংশ্লিষ্টতা আছে, পুলিশ তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
ওই দিন অভিযানে থাকা একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ওই ক্যাসিনোর মালিক ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী (সম্রাট)। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওই দলকে সম্রাটের বাহিনী ঘিরে ধরে। সরকারের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী উল্টো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দলটিকে জেরা করতে শুরু করে। একজন মন্ত্রী ক্ষুব্ধ সম্রাটকে শান্ত করেন।
এ বিষয়ে সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, মাস ছয়েক আগে তিনি একটি বাড়িতে ক্যাসিনো চালুর খবর পান। সেই খবর পেয়েই অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। তা ছাড়া ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ছয়তলা ভাড়া নিয়ে জুয়ার আসর বসিয়েছিলেন, সেটিও বন্ধ করেছেন, গুলশানেও একটি অভিযান পরিচালনা করেন। জুয়া খেলা কোথাও কোথাও হয় বলে খবর থাকলেও ‘ক্যাসিনো’ খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা। তিনি উল্টো সংবাদমাধ্যমকে দোষারোপ করেন, কেন তারা এ সম্পর্কে লেখেনি।
গণমাধ্যম সম্পর্কে পুলিশের সাবেক কমিশনারের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন প্রবীণ সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গণমাধ্যম যদি কিছু না করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বাভাবিক কাজকর্ম আটকে থাকবে, এমনটি হতে পারে না। হঠাৎ গণমাধ্যমের ওপর এত দায়িত্ব চাপানো ঠিক নয়। তবে যেকোনো খবর খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের স্বাভাবিক দায় আছে। আবার বাস্তব প্রেক্ষাপট, বাধা–বিপত্তি এবং চাপের কারণে অনেক সময় সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না গণমাধ্যম।