জেনারেল নিয়াজি তাঁর অফিসে আমাকে স্বাগত জানান। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিষয়ের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জামশেদ, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, বিমানবাহিনীর এয়ার কমোডর ইমাম ও ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী। মেজর জেনারেল জি সি নাগরা জামালপুরে গুরবক্স গিল আহত হওয়ার পর যিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, কিছুক্ষণ আগে এসে পৌঁছান। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক দিন পর নাগরা পাকিস্তানি আউটপোস্টে একটি বার্তা পাঠান, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি মিরপুর ব্রিজে। তোমার প্রতিনিধি পাঠাও। নিয়াজি, যিনি আমাকে আশা করছিলেন, এই বার্তা পেয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
আমি নিয়াজিকে বললাম যে টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে। তাঁর উচিত লড়াই বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট বাহিনীর প্রতি অর্ডার ইস্যু করা। নিয়াজি যখন অর্ডার ইস্যু করছেন, তখন নাগরাকে বাইরে ডেকে এনে আমি তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিই। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য ঢাকার অভ্যন্তরে আনতে হবে। তারপর আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের প্যারাশুট রেজিমেন্ট ও একটি পাকিস্তানি ইউনিট দিয়ে নাগরাকে আমি গার্ড অব অনারের আয়োজন করতে বলি।
আমি নিয়াজির অফিসে ফিরে এলে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তাবলি পাঠ করে শোনান। নিয়াজির চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। তাদের আশা ছিল, ১৪ ডিসেম্বর স্পিভ্যাককে দেওয়া তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই দলিল প্রণীত হবে, যেটাতে জাতিসংঘের দেওয়া ব্যবস্থা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ও প্রত্যাবর্তন কার্যকর করা হবে। ফরমান আলী ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান। নিয়াজি বলেন, আমি তাঁকে যেটাতে সই করতে বলছি, সেটা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিল। তাঁকে আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিই যে সৈনিকের প্রাপ্য সম্মান তাঁরা পাবেন এবং জেনেভা কনভেনশন কঠোরভাবে পালন করা হবে। অন্যদের পড়ার জন্য নিয়াজি দলিলটি এগিয়ে দেন। তাঁরা এর কিছু পরিবর্তন দাবি করেন। আমি আবারও বলি যে এর শর্তাবলি যথেষ্ট উদার। এরপর তাঁদের আলোচনার সুযোগ দিয়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানি সেন্ট্রির সঙ্গে গল্পগুজব শুরু করি।
আমি অফিসে ফিরলে নিয়াজি বললেন, যারা তখন পর্যন্ত প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল, তাদের কাছেও যুদ্ধবিরতির নির্দেশ পৌঁছে গেছে এবং কোথাও আর কোনো লড়াই নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, দলিলটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না। কোনো মন্তব্য না করে তিনি কাগজটা আমাকে ফেরত দেন। সেটাকে আমি তাঁর সম্মতি হিসেবে ধরে নিই।
এরপর আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া নিয়ে নিয়াজির সঙ্গে আমরা আলোচনা করি। তিনি চান যে আত্মসমর্পণ এই অফিসেই অনুষ্ঠিত হোক। রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমাদের পরিকল্পনা তাঁকে জানাই। ‘এটা ঠিক নয়’ বলে তিনি প্রতিবাদ করেন। আমি তাঁকে বললাম, ভারতীয় ও পাকিস্তানি ডিটাচমেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করবে। এরপর অরোরা ও নিয়াজি দলিলে স্বাক্ষর করবেন। সবশেষে নিয়াজি তাঁর তরবারি সমর্পণ করবেন। নিয়াজি জানালেন, তাঁর কোনো তরবারি নেই। আমি বললাম, সে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পিস্তল সমর্পণ করবেন। মনে হলো, তিনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি নীরব রইলেন। এটাও আমি তাঁর সম্মতি হিসেবে ধরে নিলাম।
আনুমানিক তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের শর্তাবলি চূড়ান্ত করে উপযুক্ত একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হয়।
মুক্তিবাহিনীর ব্যাপারে নিয়াজি সন্ত্রস্ত ছিলেন বলে তিনি জানতে চান, আত্মসমর্পণের পর তাঁর লোকজনের নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হবে। আমি এই বলে তাঁকে আশ্বস্ত করি, আমাদের সৈন্যরা শহরে ঢুকতে শুরু করেছে এবং ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি তারা সঞ্চার করতে পারবে।
লাঞ্চের পর অরোরার ঢাকায় পৌঁছানোর আনুমানিক সময় জানতে চেয়ে কলকাতায় আবার একটা রেডিও মেসেজ পাঠাই। তাদের কাছে কোনো খবর পাওয়া গেল না। বেলা তিনটায় নিয়াজিকে আমি আমাদের সঙ্গে এয়ারপোর্টে যেতে বলি। সামনে পাইলট-জিপ নিয়ে আমরা তাঁর গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট যাই। চতুর্দিক থেকে হালকা অস্ত্রের বিচ্ছিন্ন গোলাগুলির শব্দ তখনো শোনা যাচ্ছিল। অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে আমরা এয়ারফিল্ডে পৌঁছাই। পৌঁছানোর অব্যবহিত আগে রাস্তা হারিয়ে ফেলা দুই ভারতীয় প্যারাট্রুপারসহ একটি জিপ থামিয়ে তাদের আমাদের সঙ্গে আসতে বলি। এটা ছিল সৌভাগ্যের ছোঁয়া। এয়ারফিল্ডে নিয়াজির নিরাপত্তা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। পাইলট-জিপে পাকিস্তানি মিলিটারি পুলিশের হাতে ছিল রিভলবার। প্যারাট্রুপার দুজনের হাতের রাইফেল ছাড়া দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো ভারতীয় সৈন্যের দেখা নেই। খারাকে আমি বললাম, নাগরা যেহেতু কাউকে পাঠাননি, খারার উচিত হবে কিছু ভারতীয় সৈন্য, সম্ভব হলে কিছু ট্যাংক সংগ্রহ করা। আমরা জানতাম, চতুর্থ কোর ১৫ ডিসেম্বর রাতে কিছু ট্যাংক মেঘনা নদী পার করার চেষ্টা করছিল। কী করা যায়, দেখতে খারা বেরিয়ে যান। এর সামান্য পরে এক ট্রাকবোঝাই মুক্তিবাহিনী রানওয়ের অন্য পাশে এসে থামে। মুক্তিবাহিনীর দুজন সৈন্যের পেছনে কাঁধে মেজর জেনারেল র্যাঙ্কের ব্যাজ লাগিয়ে একজন লোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। এই লোকটিই ‘বাঘা’ সিদ্দিকী, যাঁকে আমি তাঁর সম্পর্কে শোনা বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে চিনতে পারি। বিপদের গন্ধ পেয়ে আমি নিয়াজিকে আড়াল করার জন্য প্যারাট্রুপার দুজনকে নির্দেশ দিয়ে সিদ্দিকীর দিকে এগিয়ে যাই। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার জন্যই নিয়াজিকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি আশঙ্কা করছিলাম, সিদ্দিকী হয়তো নিয়াজিকে গুলি করতে এসেছেন। ভদ্রভাবে আমি সিদ্দিকীকে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করতে বললে তাঁর মধ্যে নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এরপর অর্ডার হিসেবে আমি এর পুনরাবৃত্তি করি। তখনো তিনি ইতস্তত করছিলেন। তারপর সিদ্দিকী রুষ্টভাবে রানওয়ে অতিক্রম করে ট্রাকের দিকে রওনা দেন।
আনুমানিক বিকেল সাড়ে চারটায় আর্মি কমান্ডার ও তাঁর সফরসঙ্গীরা পাঁচটি এমআই৪ ও চারটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারের এক বহরে করে ঢাকায় পৌঁছান। নিয়াজি ও আমি তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে যাই। মিসেস অরোরাকে সঙ্গে নিয়ে আর্মি কমান্ডার নেমে আসেন। আরও অবতরণ করেন এয়ার মার্শাল দেওয়ান, ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণণ, লেফটন্যান্ট জেনারেল সগত সিং, চতুর্থ কোরের ডিভিশনাল কমান্ডাররা ও উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। ওসমানীকে অবশ্য দেখা গেল না। নিয়াজি, লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোরা ও এয়ার মার্শাল দেওয়ান গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। আমারও এই গাড়িতেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মিসেস অরোরা তাঁর স্বামীর পাশের আসন দখল করায় সেই আশা আমাকে ছাড়তে হয়। গাড়ি রওনা দিয়ে দিলে আমিও অন্য গাড়িতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে রেসকোর্স ময়দানের দিকে যাত্রা করি। আয়োজনের জন্য সময় খুব কম থাকা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটি মোটামুটি ভালোভাবে সম্পন্ন হয়।
গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরোরা ও নিয়াজি টেবিলের দিকে এগিয়ে যান। অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজি সেটার ওপরে কৌতূহলী চোখ বুলিয়ে নিয়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন। দলিলের ওপরে সতর্ক দৃষ্টিপাত করার সময় এটার শিরোনাম লক্ষ করে আমি হতবুদ্ধি হয়ে যাই। সেখানে লেখা আছে ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার—টু বি সাইনড অ্যাট ১৬৩১ আওয়ার্স আইএসটি (ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম)’। ঘড়ির দিকে চোখ ফেলে দেখি, সময় তখন বিকেল চারটা পঞ্চান্ন মিনিট। এরপর নিয়াজি তাঁর কাঁধ থেকে এপালেট (সেনা অধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ) খুলে ফেলেন এবং ল্যানিয়ার্ল্ডসহ (ছোট দড়িবিশেষ) .৩৮ রিভলবার অরোরার হাতে ন্যস্ত করেন। তাঁর চোখে জল দেখা যাচ্ছিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল।
আমরা কয়েকজন সিনিয়র অফিসার মিলে নিয়াজির জন্য একটি বেষ্টনী রচনা করে তাঁকে পাহারা দিয়ে একটি ভারতীয় জিপের কাছে নিয়ে যাই। পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং বন্দীদের ভারতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সগত সিংকে আমি ব্রিফ করি। এরপর আগরতলায় যাওয়ার উদ্দেশে আমরা ঢাকা বিমানবন্দরে আসি।
কয়েক দিন পরে নিয়াজির সমর্পণ করা রিভলবারটি পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারি, অস্ত্রটি নিয়াজির নয়। এটা একটা সাধারণ আর্মি ইস্যু .৩৮ রিভলবার। ময়লায় এর ব্যারেল বন্ধ হয়ে আছে এবং মনে হয়, বেশ কিছুদিন এটা পরিষ্কারও করা হয়নি। ল্যানিয়ার্ডটিও নোংরা, ঘর্ষণের ফলে কয়েকটি জায়গা ছিঁড়ে গেছে। এটা কোনো কম্যান্ডিং জেনারেলের ব্যক্তিগত অস্ত্র হতে পারে না, বরং মনে হয়, নিয়াজি এটা তাঁর কোনো মিলিটারি পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অস্ত্র হিসেবে সমর্পণ করেছেন। আমার মনে হলো, নিয়াজির ভাগ্যে যা ঘটেছে, সেটা তাঁর প্রাপ্য ছিল।
অনুবাদ: আনিসুর রহমান মাহমুদ
সূত্র: সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা, ইউপিএল, ১৯৯৯
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব: ভারতীয় েসনাবািহনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান