ডিজিটাল উদ্যোগে সাফল্য
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এসএসসি ও এইচএসসিতেও ভালো ফল। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে কম্পিউটার প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি রাকিবুলের। বড় ভাই-বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করলেও নিজের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি ধরেছিলেন সংসারের হাল। পরিবারের পাহাড়সমান দায়িত্বের বোঝায় যখন চিড়েচ্যাপ্টা হওয়াই নিয়তি, তখন রাকিবুল ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে। তিনি এখন দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সেরা ডিজিটাল উদ্যোক্তা।
পুরো নাম রাকিবুল ইসলাম, বাড়ি বরগুনার বামনা উপজেলার চালিতাবুনিয়া গ্রামে। ২৪ বছরের এই তরুণ মফস্বল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর, স্পেনে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করে আয় করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। শূন্য থেকে শুরু করে রাকিবস আইএলসি ও মার্কেটিক নামের দুটি ডিজিটাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী এখন রাকিবুল। সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি শুধু নিজের পরিবারের অভাবই দূর করেননি, চলতি করোনাকালের শুরু থেকে তিনি সমাজের দরিদ্রদেরও জুগিয়ে আসছেন সহায়তা।
দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে রাকিবুল প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করেন। অথচ ১১ বছর আগে তাঁর পরিবার প্রায় পথে বসার অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। ২০০৭ সালের শেষের দিকে তাঁর ব্যাংকার বাবা গ্রামের বাড়ির জমিজমা নিয়ে কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েন। ২০০৯ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বাবার পেনশনের টাকার পুরোটাই শেষ হয় মামলার পেছনে। পরিবারে দেখা দেয় চরম আর্থিক অনটন। দুই ভাই ও এক বোনের পরিবারে রাকিবুল ছোট। ভাই-বোন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বাবার পেনশনের টাকা ছাড়া আয়ের কোনো বিকল্প উৎসও ছিল না। পরিবারের জোগানো বাবার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মায়ের গয়না বন্ধক রেখে শুরু
লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিলেন রাকিবুল। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর বরগুনায় গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ইন্টারনেট উৎসব হয়। তখন তিনি বরগুনা সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি অংশ নেন ওই উৎসবে। প্রায় ৫০০ প্রতিযোগীকে টপকে জেলার আই-জিনিয়াস নির্বাচিত হন তিনি। এটাই তাঁর এগিয়ে চলার আত্মবিশ্বাসের প্রথম বীজ বপন করে।
২০১২ সালে রাকিবুল সবে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুনো ১৭ বছরের এক কিশোর। সে সময় টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারেননি। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বাবার আর্থিক দুরবস্থা দেখে তাঁর মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প করেন। শুরু করেন চাকরি খোঁজা। যদিও হন্যে হয়ে ঘুরেও কোনো চাকরি জোটেনি তাঁর। এরপরও হাল ছাড়েননি রাকিবুল।
এর মধ্যে পত্রিকায় আউটসোর্সিং সম্পর্কে জেনে এ বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় রাকিবুলের। কিন্তু শেখার কোনো উপায় পাচ্ছিলেন না। আউটসোর্সিং শিখতে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন তিনি। সেখানে প্রশিক্ষণ ও তিন মাসের থাকা-খাওয়ার খরচ জোগান দেওয়া অসম্ভব ছিল পরিবারের পক্ষে। টাকা জোগাড়ের জন্য নিজের মুঠোফোন বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু তাতেও খরচের টাকা না উঠলে মায়ের গয়না বন্ধক রেখে তিনি পাড়ি জমান ঢাকায়।
ঢাকায় তিন মাস ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ শেষ করে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাকিবুল বরগুনায় ফেরেন। এবার নিজেকে আউটসোর্সিং বিষয়ে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েন। একটানা ছয় মাসের চেষ্টার পর আউটসোর্সিং দুনিয়ার বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে কাজ শুরু করেন অনলাইন মার্কেটপ্লেস ই–ল্যান্সে (বর্তমানে আপওয়ার্ক)। তাঁর প্রথম আয় ছিল ১০ ডলার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি একাই ঘরে বসে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নামী কোম্পানিতে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ সফলভাবে সম্পাদন করেন।
২০১৪ সালে কাজের চাপ বাড়ায় রাকিবুল বরগুনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ৮০০ বর্গফুটের একটি অফিস ভাড়া নেন। সেখানে তিনজন কর্মী নিয়ে শুরু করেন ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান রাকিবস আইএলসি । এর মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর উদ্যোক্তাজীবন। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ২৫ জন দক্ষ কর্মী।
বরগুনা সরকারি কলেজের আইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জাহাঙ্গীর কবির বলেন, রাকিবুল আমার ছাত্র। ও ভীষণ মেধাবী। উদ্যোক্তা হিসেবে ওর সফলতা ঈর্ষা করার মতো। বরিশাল বিভাগে এত কম বয়সে প্রযুক্তি খাতে এত বড় উদ্যোক্তা আমার জানামতে নেই। ওর অফিসে গিয়ে আমি অভিভূত হয়েছি।
মান ও পেশাদারত্বে আপস নয়
রাকিবুল বলেন, বিপিও যেহেতু একটি বৈশ্বিক বাজার, সেখানে সেরাদের সেরা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা করা যায় না। একটি কাজ পাওয়ার জন্য উন্নত দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে কাজের মান নিশ্চিত করতে হবে সব সময়। আর পেশাদারত্বে হতে হবে সেরা।
ঠিক এ কারণেই রাকিবুলের প্রতিষ্ঠান আজ বিশ্ববাজারে নিজের একটি স্থান তৈরি করতে পেরেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে তাঁর ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান মার্কেটিক । যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়াতে চায় কিন্তু পারছে না, রাকিবুলের টিম অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাদের সাহায্য করে। একটি ব্যবসাকে পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে চলেছে তাঁর দল।
তরুণ রাকিবুলের কুশলী ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বেশি প্রমাণ মেলে এই করোনা অতিমারিতে। সরকারিভাবে লকডাউন দেওয়ার আগেই তিনি তাঁর টিমসহ শুরু করেন হোম অফিস। ছোট প্রতিষ্ঠান হলেও পুরোপুরি করপোরেট ব্যবস্থায় চলার কারণেই দ্রুত এ ধরনের পদক্ষেপ সফল হয়েছে। দৈনিক কার্যক্রম, কর্মী ব্যবস্থাপনা, নতুন কর্মী নিয়োগ—সবই চলছে অনলাইনে। বর্তমানে বরগুনা সদর, বেতাগী, পাথরঘাটা, মাদারীপুর, সুনামগঞ্জ, বরিশাল থেকে ৩৫ জন কর্মী হোম অফিস থেকে কাজ করছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে।
মার্কেটিকের পিপল অপারেশন বিভাগের প্রধান আল আমিন জানান, তাঁদের ওয়েবসাইটে (WWW.MARKETICBD.COM) স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া এবং অনলাইন প্রশিক্ষণ ভিডিওর মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত কর্মী বাছাই করা হয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে। এ ছাড়া WWW.LOKJON.COM এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টেকনিক্যাল কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। মাসিক নির্দিষ্ট বেতনের সঙ্গে থাকে বোনাস। আর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলেই থাকে মাসিক বাজার (রেশন) সুবিধা। দুই
রাকিবুলের আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন সফলতার সঙ্গে। অনেকে হয়ে উঠেছেন তাঁর মতো উদ্যোক্তাও।
হোপ বরগুনা : রাকিবুলের মানবিক উদ্যোগ
শুধু উদ্যোক্তা হিসেবে নয়, মানবিক কাজেও রাকিবুলের রয়েছে সরব উপস্থিতি। করোনাকালে যখন চারপাশের দিন আনে দিন খায় পরিবারগুলো খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন ভেতরকার মানবিক তাগিদ থেকে তিনি গড়ে তোলেন অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবা প্রতিষ্ঠান হোপ বরগুনা । প্রাথমিকভাবে নিজেদের অর্থ দিয়ে কাজ শুরু করলেও তাঁদের কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এখন অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। লকডাউনের শুরু থেকে ১১ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তাঁরা নিরবচ্ছিন্ন ১২৮ দিন মানবিক সুবিধা পৌঁছে দিয়েছেন বিভিন্ন কর্মহীন পরিবারের মধ্যে।
রাকিবুল বলেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) আওতায় আমরা মার্কেটিক থেকে আয়ের পাঁচ ভাগ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক ও মানবিক কাজে ব্যয় করব।
রাকিবুল বলেন, দেশে এখন সাত লাখের মতো ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। এর মধ্যে যদি এক ভাগও এন্টারপ্রাইজ উদ্যোক্তা তৈরি হয়, তবে সাত হাজার আউটসোর্সিং এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি তৈরি হতে পারে। সেখানে ২০০ জন করে কাজ করলেও ১৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। ভারতের ইনফোসিস, টিসিএসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যদি পারে, তবে আমরাও পারব। কথাগুলো বলার সময় রাকিবুলের চোখ জ্বলজ্বল করছিল।
একজন স্বপ্নবাজ তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে রাকিবুল গত ৭ বছরে এলাকার প্রায় ৪০০ তরুণকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ, ১৫০ তরুণের কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করেছেন। একই সঙ্গে করোনাকালে তাঁর হোপ বরগুনার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার অসহায় পরিবার সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে। করোনার দুঃসময়ে তাঁর টিম একটানা ১৫৯ দিন রান্না করা খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য গরিব ও অসহায় পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এমন কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবার তিনি প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে আউটসোর্সিং। এ খাতে রাকিবুল একজন সফল উদ্যোক্তা। তাঁর মতো তরুণ উদ্যোক্তা আমাদের গর্ব। রাকিবুলের এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে আমাদের কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমরা তা দেব।