বাঙালি জাতিকে মেধা ও মননে নিঃস্ব করে দিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। ৪৩তম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস থেকে সেই সব জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন
গণিতের অসাধারণ এক শিক্ষক ছিলেন ড. আবুল কালাম আজাদ। ষাটের দশকে গণিতজ্ঞ হিসেবে তাঁর নাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। লন্ডনের রাজকীয় আবহাওয়াবিজ্ঞান সমিতি, যুক্তরাজ্যের ফলিত গণিত সমিতি ও বোস্টনের আবহাওয়াবিজ্ঞান সমিতির ফেলো ছিলেন তিনি। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের উষালগ্নে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের একটি দল তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আবুল কালাম আজাদ ছাত্রজীবনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষকতাকালে (১৯৫৮-৭১) এ দেশের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে নানা কর্মসূচিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অবরুদ্ধ ঢাকায় তিনি পরিবারসহ থেকে যেতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পারলেও যখনই পেরেছেন গোপনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছেন।
অবিবাহিত আবুল কালাম আজাদ মা, চার ভাই ও চার বোনসহ থাকতেন ঢাকার আজিমপুরে। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবা বেঁচে না থাকায় তিনিই ছিলেন তাঁদের অভিভাবক। অবরুদ্ধ জীবনের মধ্যে তাঁকে ভাইবোনদের আগলে রাখতে হয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরিবারের সবাইকে বেঁচে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন।
আবুল কালাম আজাদ নিশ্চিত ছিলেন, এ দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও এই স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি। দুর্ভাগ্য তাঁর, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক দিন আগে, ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের একটি দল তাঁকে আটক করে অজ্ঞাত এক স্থানে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা রায়ের বাজার বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেছেন। কোথাও তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
শিক্ষাজীবনে গণিতের তুখোড় ছাত্র ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। এরপর যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরল পদার্থসম্পর্কিত বলবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা, ফলিত গণিতে এমএসসি এবং ম্যাথবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
তাঁর জন্ম কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে ১৯৩৩ সালের ১ জানুয়ারি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯৫৮ সালের নভেম্বর মাসে সরকারি কলেজের অঙ্কের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। পরে সরকারি জগন্নাথ কলেজের গণিত বিভাগে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। জগন্নাথ কলেজে একপর্যায়ে গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হন। ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি টিচিং-এ যোগ দেন। নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যাপনা করেন।
সূত্র: শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ, সম্পাদনা রশিদ হায়দার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (প্রথম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯১)।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান