ট্রেনে অর্ধেকেরও অর্ধেক যাত্রী, বিধিনিষেধ তোলা নিয়ে দ্বিধা
ভয়–আতঙ্ক ঠেলে ঠেসে যাত্রী উঠে ট্রেন ভরে যাবে—শুরুতে এমনটাই ভেবেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। এর জন্য নানা বিধিনিষেধ, কৌশল এবং সতর্কতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। তবে সীমিত আকারে ট্রেন চালুর ১৫ দিনের মূল্যায়ন বলছে, যাত্রীদের আতঙ্ক কাটেনি। তাই বেশির ভাগ ট্রেনই ফাঁকা চলছে। এর মধ্যে যাত্রীসংকটে দুটি ট্রেনের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যাত্রী বাড়ানোর জন্যে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ।
সরকার সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর গত ৩১ মে থেকে আট জোড়া ট্রেন চালু করে রেলওয়ে। ৩ জুন আরও ১১ জোড়া ট্রেন নামানো হয়। সিদ্ধান্ত ছিল, প্রথম ১৫ দিন চালানোর পর মূল্যায়ন করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার সবকিছু স্বাভাবিক করে দিতে চাইছে, এমনটা ভেবে আরও আট জোড়া ট্রেন চালুরও একটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ৩১ মে থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন ও আয়ের মূল্যায়ন করে সে পথে এগোনোর সাহস পায়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অধিকন্তু গত শনিবার ঢাকা–চট্টগ্রাম পথের সোনার বাংলা এক্সপ্রেস এবং রোববার ঢাকা–নোয়াখালী পথের উপকূল এক্সপ্রেস বন্ধ হয়ে যায়।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টির জায়গা শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা গেছে। এর বাইরে যাত্রী কিংবা আয়ের দিক বিবেচনা করলে ট্রেন চালানোটা অনেকটা আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে। কারণ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে এমনিতেই প্রতিটি ট্রেন অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখা হচ্ছে। বাকি অর্ধেকের ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা যাচ্ছে বেশ কিছু ট্রেনের। এ পর্যন্ত চালু ট্রেনের ৯০ শতাংশেরই অর্ধেক আসন পূর্ণ হচ্ছে না।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রেল এমনিতে লোকসানি প্রতিষ্ঠান। এভাবে যাত্রীশূন্য ট্রেন চালাতে থাকলে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে কাউন্টারে টিকিট বিক্রি শুরু, কিছু বন্ধ স্টেশন চালু এবং কিছু কিছু মেইল বা কমিউটার ট্রেন চালু করলে যাত্রী বাড়তে পারে।
রেলে শতাধিক আন্তনগর ট্রেন আছে। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম যাত্রাবিরতির ট্রেনগুলো প্রথমে চালু করা হয়েছে। যাত্রীর চাপ সামলানো যাবে না—এই বিবেচনায় শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। বিমানবন্দর, গাজীপুর, নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ অনেক স্টেশনে ট্রেন থামছে না।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, আরও আট জোড়া ট্রেন চালুর ইচ্ছা তাঁদের ছিল। কিন্তু যাত্রীর সাড়া মেলেনি। বিমানবন্দর স্টেশনটি শিগগিরই চালু করা হবে। এ জন্য অস্থায়ী বেড়া দেওয়া হবে। আরও নতুন ট্রেন নামানো এবং বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করার বিষয়ে আগামী মাসের শুরুতে বিবেচনা করা হবে। এখন কিছু কিছু জেলা নতুন করে লকডাউন করা হচ্ছে। এগুলো মূল্যায়ন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুই ট্রেন যে কারণে বন্ধ:
বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন সুবর্ণ ও সোনার বাংলা এক্সপ্রেস। ঢাকা–চট্টগ্রামের মধ্যে দুই দিক থেকে প্রতিদিনই চারটি ট্রেন চলে। মাঝখানে শুধু ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রাবিরতি আছে। কিন্তু করোনা–পরিস্থিতিতে তা–ও বন্ধ। রেলের টিকিট বিক্রিসংক্রান্ত তথ্য বলছে, দুটি ট্রেনই ব্যাপকভাবে যাত্রীখরায় ভুগছে।
৩১ মে থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের পথের দুটি সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে ১১ হাজার ৮০৪টি টিকিট বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু এ সময় টিকিট বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৪০টি। উন্মুক্ত করা টিকিটের মাত্র ৫১ দশমিক ১৭ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ শুরুতেই ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখা হচ্ছে। বাকি ৫০ শতাংশের প্রায় অর্ধেক আসনেও যাত্রী পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এই ট্রেনে ৭৪ শতাংশ আসনই ফাঁকা চলেছে।
সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের দুটি ট্রেন ১৪ হাজার ৬০০ আসন নিয়ে চলাচল করেছে। বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল ৭ হাজার ৪২৫টি আসন। কিন্তু প্রথম ১৫ দিনে টিকিট বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ১৬৩টি। অর্থাৎ উন্মুক্ত টিকিটের ৪৪ দশমিক ২২ শতাংশ বিক্রি হয়নি। আর পুরো ট্রেনে থাকা আসন বিবেচনায় নিলে ফাঁকা চলেছে ৭১ দশমিক ৪৯ শতাংশ আসন।
রেলের অতীত ইতিহাস বলছে, ঢাকা–নোয়াখালী পথের উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে সব সময় যাত্রী বেশি হয়। তবে এবার ৩ জুন ট্রেনটি চালু হওয়ার পর সেই যাত্রীর দেখা মেলেনি। পরিসংখ্যান বলছে, আসা–যাওয়া দুটি ট্রেনে ১৪ জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৯২৩টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। অথচ ট্রেন দুটি এ সময় ১২ হাজার ৩৫৮টি টিকিট বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। অর্থাৎ সরকার যে অর্ধেক আসনের টিকিট বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিল, এরও প্রায় ৫১ শতাংশ বিক্রি হয়নি। পুরো ট্রেনের সক্ষমতা বিবেচনায় নিলে ৮৬ শতাংশ আসনই ফাঁকা চলেছে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা–চট্টগ্রাম পথে স্বাভাবিক সময়ে কাছাকাছি মানের আটটি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। সব ট্রেনেই যাত্রী হয়। এর মধ্যে সোনার বাংলা ও সুবর্ণ এক্সপ্রেস খুবই লাভজনক ট্রেন। কিন্তু লকডাউনের পর এই দুই ট্রেনেরই যাত্রী হচ্ছে না। এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, মানুষ ভয়ে যাতায়াতই কমিয়ে দিয়েছেন। কাউন্টারে টিকিট না বিক্রি করে সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি করাও একটা কারণ। এ ছাড়া বিমানবন্দর স্টেশন বন্ধ থাকার কারণেও যাত্রী কম হতে পারে।
অন্যদিকে উপকূল ট্রেনটিতে যাত্রী কম হওয়ার বড় কারণ, ট্রেনটি চালু হওয়ার দুদিন পর থেকেই নোয়াখালী জেলা লকডাউন। এ জন্য ট্রেনটি নোয়াখালী যেতে পারে না। লাকসাম থেকে ফিরে আসে। কাউন্টারে টিকিট না থাকাও একটা কারণ। এ ছাড়া উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্বাভাবিক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, আখাউড়া ও কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি দিত। এখন তা বন্ধ করা হয়েছে। এ জন্যও যাত্রী কমে যাচ্ছে বলে ধারণা রেলের কর্মকর্তাদের।
পশ্চিমাঞ্চলে যাত্রী বেশি:
রেল কর্তৃপক্ষের মূল্যায়নে দেখা যায়, রেলের পশ্চিমাঞ্চলে তুলনামূলক যাত্রী বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের ট্রেনগুলোতে অর্ধেক আসনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ট্রেনে যাত্রী তুলনামূলক বেশি। সিলেট–চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম–চাঁদপুরের মধ্যে চলাচলকারী চারটি আঞ্চলিক আন্তনগর ট্রেনেও যাত্রী ভালো হয়েছে। কারণ, এসব ট্রেনে যাত্রাবিরতি তুলনামূলক বেশি।
চট্টগ্রাম–সিলেট পথের উদয়ন ও পাহাড়িকা ট্রেনে উন্মুক্ত টিকিটের ৭৫ শতাংশের বেশি বিক্রি হয়েছে। চট্টগ্রাম–চাঁদপুর পথের মেঘনা ট্রেনেও একই অবস্থা। পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের মধ্যে ঢাকা–খুলনা পথের চিত্রা, রাজশাহী পথের বনলতা, পঞ্চগড় পথের পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনে উন্মুক্ত টিকিটের প্রায় ৮০ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। কিন্তু বেনাপোল এক্সপ্রেসে উন্মুক্ত টিকিটের অর্ধেকই অবিক্রিত ছিল।