সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)
টিকাদানে নায়ক বাংলাদেশ
দেশে বর্তমানে ১০ ধরনের টিকা দেওয়া হয়। শূন্য থেকে দুই বছর বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম সব নারী টিকা কর্মসূচির আওতায় আছে।
স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য ঠিক সময়ে ঠিক টিকাটি শিশু ও মাকে দিতে পারা। দেশের মানুষকে টিকা দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি কুড়িয়েছে। এই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গাভি) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করে। এরও আগে বাংলাদেশ ২০০৯ ও ২০১২ সালে ‘গাভি বেস্ট পারফরম্যান্স’ পুরস্কার লাভ করেছিল।
বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিশুদের ভাগ্য অনেক ভালো। বয়স দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে দেশের ৮২ শতাংশ শিশু টিকা পেয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে এই হার ৯৯ শতাংশ। এর পেছনে আছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই। ‘আপনার শিশুকে টিকা দিন’ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির এই বিনয়ী আহ্বানে সারা দেশের মানুষ সাড়া দিয়েছে। ফলে দেশে বেশ কিছু সংক্রামক রোগের প্রকোপ কমে গেছে, কিছু রোগ নির্মূল হয়েছে।
টিকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই সাফল্য একদিনে অর্জিত হয়নি। স্বাধীনতার সময় দেশে শিশুমৃত্যুহার অনেক বেশি ছিল। শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি। এসব ব্যাধি থেকে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে দেশে শুরু হয় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি।
ইপিআইয়ের শুরুর দিকে টিকা দেওয়া হতো হাসপাতালে। টিকা পেত মূলত শহরের শিশুরা। তখন শিশুরা ছয়টি রোগের টিকা পেত। রোগের তালিকায় ছিল: যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও ও হাম।
ইপিআই শুরুর ছয় বছর পর অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে ২ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় আসে। ওই বছরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের সব শিশুকে টিকার আওতায় আনার উদ্দশ্যে শুরু করে ‘ইউনিভার্সাল চাইল্ডহুড ইমিউনাইজেশন’ কর্মসূচি। তখন থেকে শহর ও গ্রামের সব শিশুকে টিকা দেওয়া শুরু হয়।
দেশের সব শিশুকে টিকার আওতায় আনা ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কীভাবে দেশের সব পরিবারের টিকা পৌঁছানো যাবে, বিপুল পরিমাণ জনবল কোথায় পাওয়া যাবে, এসব জনবলের প্রশিক্ষণের কী হবে, টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা কী হবে—এই প্রশ্নগুলো অনেক বড় ছিল। স্বাস্থ্য বিভাগ এসব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে ধীরে ধীরে কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে।
এ কাজে স্বাস্থ্য বিভাগকে সহায়তা দিয়ে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ দেশি-বিদেশি অনেক এনজিও।
মাঠপর্যায়ে টিকা দেওয়ার কৌশল উদ্ভাবন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। প্রতিটি ইউনিয়নের তিনটি পুরোনো ওয়ার্ডে আটটি করে সাব-ব্লকে ভাগ করা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিয়নে ২৪টি সাব-ব্লক আছে। স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে প্রতিটি ব্লকে একটি করে অস্থায়ী টিকাকেন্দ্র করা হয়।
কেন্দ্রগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারও না কারও বাড়ি। ইউপিআইয়ের কর্মকর্তারা এসব কেন্দ্রকে বলেন ‘আউটরিচ কেন্দ্র’। প্রতিটি সাব-ব্লকে মাসে একবার করে টিকা দেওয়া হয়। ইপিআইয়ের কর্মীরা এলাকার প্রতিটি বাড়ির টিকা পাওয়ার উপযোগী সব শিশু ও মহিলাকে নিবন্ধন করেন। নিবন্ধিত সবার জন্য একটি করে টিকা কার্ড আছে।
এ ছাড়া প্রতিটি উপজেলা হাসপাতাল, জেলা ও সদর হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকাকেন্দ্র আছে।
টিকাকেন্দ্রগুলোতে নির্দিষ্ট দিনে টিকা পৌঁছে দেওয়ার পৃথক জনবল আছে। তারা নির্দিষ্ট স্থান থেকে ক্যারিয়ার বা বক্সে করে টিকা নিয়ে আউটরিচ কেন্দ্রে পৌঁছে দেন। তবে টিকা নির্দিষ্ট কেন্দ্রে পৌঁছানো পর্যন্ত নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখার দরকার হয়। টিকার এই ‘কোল্ড চেইন’ বজায় রাখার জন্য দেশে মূলত তিনটি ধাপ মেনে চলা হয়। প্রথম ধাপে আমদানি করা সব টিকা ইপিআইয়ের কেন্দ্রীয় গুদামে রাখা হয়। কেন্দ্রীয় গুদাম থেকে জেলা গুদামে নেওয়া হয়।
জেলা গুদাম থেকে উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের গুদামে রাখা হয়। প্রতিটি স্তরে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় টিকা রাখার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আছে। টিকা দেওয়ার দিন তৃতীয় স্তরের গুদাম থেকে টিকাকেন্দ্রে টিকা নেওয়া হয়।
গ্রামের টিকাকেন্দ্রগুলোতে টিকা দেন স্বাস্থ্য সহকারী। তাঁদের কাজ তদারকি করেন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক। আর সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের কাজ তদারকি করেন স্বাস্থ্য পরিদর্শক। তাঁদের ওপরে আছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে শহর এলাকায় বিভিন্ন এনজিও এই কাজ করে। তাদের সহায়তা করে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ ছাড়া শহরের মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে তাদের শিশুদের টিকা দেন। দেশে ১ লাখ ২০ হাজার অস্থায়ী টিকাদানকেন্দ্র এবং ৭০০ স্থায়ী টিকাদানকেন্দ্র আছে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হয়।
সময় যত গড়িয়েছে ইপিআই নতুন নতুন কর্মপন্থা হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি নতুন নতুন টিকাও ব্যবহারের জন্য সরকার উদ্যোগী হয়েছে।
নতুন নতুন কর্মসূচির নাম শোনা গেছে। যেমন ১৯৯৫ সালে পোলিও নির্মূল এবং মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার নির্মূল কর্মসূচি শুরু হয়; ২০০৩ সালে হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া শুরু হয়; ২০১২ সালে এমআর টিকা এবং হামের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়; ২০১৫ সালে পিসিভি ও আইপিভি টিকা দেওয়া শুরু হয়।
দেশে বর্তমানে ১০ ধরনের টিকা দেওয়া হয়। শূন্য থেকে দুই বছর বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম সব নারী টিকা কর্মসূচির আওতায় আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০০১ সাল থেকে টিকার আওতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০০১ সালে ১২ মাস বয়সী ৫২ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় আসে। ২০১৯ সালে এই হার বেড়ে ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়ায়।
একইভাবে ২৪ মাস বয়সী শিশুদের বিভিন্ন ধরনের টিকা পাওয়ার হারও অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিসিজি টিকা দেওয়ার হার ৯৯ শতাংশের বেশি।
ইপিআই কর্মসূচির ফলে ২০০৮ সাল থেকে মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার অনেক কমে গেছে। এখন ধনুষ্টংকারে মৃত্যুর খবর আর শোনাই যায় না। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে পোলিও নির্মূল সনদ লাভ করে।
টিকার এই সাফল্যের পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত ইপিআইয়ের ব্যাপারে সব সরকারের আমলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল। ইপিআইয়ের কর্মকর্তারা আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দেশের মানুষকে এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন।
মাঠকর্মীরা বছরের পর বছর কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে করে চলেছেন। টিকা ও টিকাদান সামগ্রীর সরবরাহে বড় ধরনের কোনো বাধার কথা শোনা যায় না। আছে শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা।
স্বাস্থ্য বিভাগ ইপিআইয়ের এই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগাচ্ছে করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ এক দিনে প্রায় ৮০ লাখ মানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার সামর্থ্য দেখিয়েছে। দেশের মানুষের কাছে টিকা সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়। ইপিআই এটা সম্ভব করেছে।
● শিশির মোড়ল: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি