জুয়ায় মুঠোফোন খুইয়ে নিরুদ্দেশ, এক যুগ পর উদ্ধার

নিখোঁজের এক যুগ পর সুমনকে উদ্ধার করে পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

সুমন যখন নিখোঁজ হন, তখন তাঁর বয়স ১৭। তাঁর বাবা মো. মোজাফফরের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁর সন্তান অপহৃত হয়েছে। পাঁচজনকে আসামি করে রাজধানীর পল্লবী থানায় মামলাও করেন তিনি। এরপর কেটে গেছে এক যুগ।

পল্লবী থানা, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঘুরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে আসে। তদন্ত শেষে জানা যায়, সুমন অপহৃত হননি। তিনি সংসার করছেন। থাকেন রাজধানীর রায়েরবাগে।

আজ মঙ্গলবার পিবিআই এক সংবাদ সম্মেলনে এক যুগ পর সুমনকে খুঁজে পাওয়ার এই তথ্য প্রকাশ করে। ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এক যুগ আগে তিন তাসের জুয়ায় ১০০ টাকা খুইয়েছিলেন সুমন। বাবাকে কী জবাব দেবেন, সেই ভয়ে পালিয়ে যান তিনি।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সুমন কর্মস্থল ডায়মন্ড প্যাকেজিং গার্মেন্টসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। এর পর থেকে তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। ওই সময় সুমনের বড় ভাই সুজন তাঁর মুঠোফোনে ফোন করলে ধরেন অপরিচিত এক ব্যক্তি। ওই বছরের ৫ অক্টোবর সুমনের বাবা মোজাফফর পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, অফিসে যাওয়ার পথে মো. সুলায়মান হোসেন (২৮), মো. শাওন পারভেজ (১৮), মো. রুবেল (২০), সোহাগ (২০) ও মানিকসহ (২৫) কয়েকজন তাঁর ছেলেকে অপহরণ করেন। এবার তিনি বাদী হয়ে অপহরণ মামলা করেন।

মামলাটি তদন্ত করেন পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হাবিবুর রহমান। তিনি সুমনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো অগ্রগতি না হলে ওই বছরের ৩০ অক্টোবর মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আয়নাল হক ‘নিখোঁজ’ সুমনের মুঠোফোন উদ্ধার করেন। তিনি মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদালতে সোপর্দ করেন। এরপর ডিবির আরও দুই এসআই মামলার তদন্ত করেন। কিন্তু কেউই সুমনকে খুঁজে পাননি।
২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের আদেশে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। তারা সুমনকে খুঁজে বের করতে না পারলেও মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, এজাহারভুক্ত আসামিরা তাঁকে অপহরণ করেননি। বাদী নারাজি দিলে আদালত মামলা আবার ডিবিতে পাঠান।

ডিবির তিন এসআই প্রায় ছয় বছর এই মামলার তদন্ত করেন। এ সময় তাঁরা জানতে পারেন, একটি জুয়ার বোর্ড থেকে সুমনের মুঠোফোন কিনেছিলেন এজাহারভুক্ত আসামি মো. সুলায়মান। কিন্তু মামলার আর কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ডিবিও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালতের নির্দেশে এবার মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।

যেভাবে সুমনের সন্ধান মিলল

২০১৯ সালে পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. তরিকুল ইসলাম মামলার তদন্ত শুরু করেন। তিনি জানতে পারেন, সুমন নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পর একটি মুঠোফোন থেকে তিনি তাঁর বাবাকে ফোন করেছিলেন। ওই ফোনের মালিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর আবদুল হাই (৪৫)।

পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে আবদুল হাই বলেন, মুঠোফোনের সিম তাঁর নামে থাকলেও তিনি ব্যবহার করতেন না। তাঁর দূরসম্পর্কের ভাগনে মো. সালাউদ্দিন এই ফোন দিয়ে মুঠোফোন রিচার্জের ব্যবসা করছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে সালাউদ্দিন বলেন, অনেক অপরিচিত মানুষ তাঁর দোকানে মুঠোফোনে কথা বলতেন। এত বছর আগে কে ফোন করেছিল, বলা সম্ভব নয়। কোনো সূত্র পেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে জানিয়ে পিবিআইও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।

গত ঈদুল ফিতরে অপরিচিত নম্বর থেকে সুমনের বাবা মোজাফফরের কাছে একটি ফোন আসে। পিবিআই তখন আদালতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন জানায়।

তদন্ত কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, এত বছর ধরে সুমন কেবল তাঁর বাবার মুঠোফোন নম্বরটিই মনে রেখেছিলেন। ঈদের দিন তিনি তাঁর স্ত্রীকে ওই নম্বরটি দিয়ে ফোন করতে বলেন। উদ্দেশ্য, বাবার কাছে থাকা বাল্যবন্ধু সাগরের নম্বর নেওয়া। ফোনটি পেয়েই মোজাফফর পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান।
২৩ মে তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় সুমনকে শনাক্ত করে পুলিশ। তাঁকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকার মদিনাবাগ থেকে আটক করে।

কেন পালিয়েছিলেন সুমন?

সুমন (৩০) পিবিআইকে বলেন, তিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ডায়মন্ড প্যাকেজিংয়ে কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

সুমন বলেন, ঘটনার দিন মিরপুর–১১ নম্বর বাজার এলাকার চার রাস্তার মোড়ে তিন তাসের জুয়ায় ১০০ টাকা বাজি ধরে হেরে যান। টাকা না থাকায় জুয়াড়িরা জোর করে তাঁর কাছ থেকে মুঠোফোন রেখে দেয়। মুঠোফোনের বিষয়ে বাবাকে কী উত্তর দেবেন, এই ভয়ে তিনি মিরপুর থেকে গুলিস্তানে যান। প্রথম দিন সুমন গুলিস্তানে ঘোরাফেরা করেন। পরদিন সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে এক ব্যক্তি তাঁকে শাহবাগ ফুল মার্কেটে নিয়ে নাশতা খাওয়ায়।

জিজ্ঞাসাবাদে সুমন আরও বলেন, শুধু থাকা–খাওয়ার শর্তে সুমন শাহবাগে হোটেলে কাজ নেন। ওই হোটেলের বাবুর্চি হারুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর। বেশ কয়েকবার ভোলার লালমোহনে গেছেন। ঢাকায় ফিরে কখনো চটপটির দোকানে কাজ করেছেন, আবার কখনো পপকর্ন বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া বাসচালকের সহকারী, রুমা অ্যাকুয়ারিয়াম সেন্টার, পপুলার অ্যাকুয়ারিয়াম সেন্টারে কাজ করেছেন।

সুমন বলেন, নান্নু ওস্তাদ নামে এক গাড়িচালকের সঙ্গে পরিচয়ের পর ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুল ও বারডেম হাসপাতালের যাত্রী আনা–নেওয়ার কাজও করেন সুমন। ইউসেপ স্কুলের জোনাকী নামের এক মেয়েকে তিন বছর আগে বিয়ে করেন। তাঁদের তিন মাস বয়সী সন্তান আছে।