গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে নিয়ে অভিযান নয়
গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে মাদক উদ্ধার অভিযানে না যাওয়ার সুপারিশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে অভিযানস্থলে নেওয়া একান্ত অপরিহার্য হলে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে রাখতে হবে।
মাদকবিরোধী অভিযানের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সরকারকে এই সুপারিশ করেছে। কমিশন চায়, এই আলোকে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দিক।
কমিশন বলছে, মানবাধিকার-সংক্রান্ত নয়টি মূল আন্তর্জাতিক সনদের মধ্যে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদসহ আটটি সনদে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। এসব সনদের মূল কথা, কোনো ব্যক্তিকে তার বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধিতে কোনো ব্যক্তিকে কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করতে হবে, তা স্পষ্ট বলা আছে। পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ কর্মকর্তার করণীয়ও সুনির্দিষ্ট করা আছে। কমিশন চায়, এসব মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য সরকার নির্দেশনা তৈরি ও জারি করুক।
কমিশন বলছে, বিভিন্ন সময় মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা বা গ্রেপ্তার ব্যক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটছে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশ হচ্ছে। এতে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ মে থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ৭১ দিনে মাদক উদ্ধার অভিযানে ১৯০ জন মারা গেছেন।
কমিশন বলছে, অভিযানের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় প্রশাসনিক নির্দেশনা প্রণয়নের জন্য সরকারকে বিভিন্ন সুপারিশ করে। সরকার এসব সুপারিশ আমলে নেয়। মাদক উদ্ধার অভিযানে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যাতে না ঘটে, এ জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সরকার সুপারিশের আলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নির্দেশনা জারি করবে বলে কমিশন আশা করছে।
মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, জীবনের অধিকার মানুষের সবচেয়ে বড় অধিকার। সংবিধান এবং অন্যান্য আইনের মাধ্যমে এই অধিকার সুরক্ষিত। তবে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে মাদক উদ্ধারের অভিযান পরিচালনা-সংক্রান্ত বিষয়ে আইনে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই।
মাদকবিরোধী অভিযান ও তদন্তে দেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করে অভিযান পরিচালনার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে কমিশন। অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তা অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। সদস্যদের অযৌক্তিক ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত রাখার ওপর গুরুত্ব দেয় কমিশন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেন ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে পারেন, এ জন্য তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদি প্রদান করতে হবে। বাহিনীকে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে এর সঠিক প্রয়োজনীয়তা ও মাত্রা নির্ধারণ করে অভিযান পরিচালনা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশনের ম্যান্ডেট এবং কমিশন সভায় আলোচনার পর বাহিনীগুলোর জন্য এসব সুপারিশ করা হয়েছে। ৮ জুলাই এই সুপারিশের কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২২ জুলাই মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটেও তা দেওয়া হয়।
মাদকের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, একটি জাতিকে অসার, পঙ্গু বা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য মাদকের চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু থাকতে পারে না। দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে, তখন মাদকের কারাগারে বন্দী হচ্ছে একটি প্রজন্ম, যা দেখে সব স্তরের মানুষ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।
মাদকমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সরকারের দৃঢ় অবস্থান বা শূন্যসহনশীলতা নীতি গ্রহণকে দেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে উল্লেখ করে সুপারিশপত্রের ভূমিকায় মাদকবিরোধী অভিযান কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছে কমিশন।