বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উদার গণতান্ত্রিক সূচক এবং নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসির (ভি-ডেম) প্রতিবেদন।
পাঁচ বছর ধরে বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট। এবারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘অটোক্রাটাইজেশন গোজ ভাইরাল’। গত ১১ মার্চ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে (লিবারেল ডেমোক্রেসি ইনডেস্ক) ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪তম। স্কোর শূন্য দশমিক ১। গতবারের চেয়ে স্কোর কমেছে শূন্য দশমিক ০১৯।
প্রতিবেদনে ‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ (ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। এই সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩৮তম, স্কোর শূন্য দশমিক ২৭। স্কোর কমেছে প্রায় শূন্য দশমিক ০৩১।
এ ছাড়া লিবারেল কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬১তম। ইগলিট্যারিয়ান কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে ১৭৬তম, পার্টিসিপেটরি কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে ১৪৩ এবং ডেলিবারেটিভ কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে বাংলাদেশ ১৫৮তম অবস্থানে আছে।
ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ (ইলেকটোরাল অটোক্রেসি) বিভাগে। এর অর্থ হলো, এ দেশে গণতন্ত্র অপস্রিয়মাণ। আর সে জায়গায় ধীরে ধীরে স্থান করে নিচ্ছে স্বেচ্ছাচারী শাসন। অবশ্য বাংলাদেশের অবস্থান আগের প্রতিবেদনেও এমনটাই ছিল। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রকৃতিগত হিসাবে এ দেশের অবস্থান অপরিবর্তিত আছে।
এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের মানুষের কৃষ্টি-কালচার, আর্থসামাজিক অবস্থান ও শিক্ষা পুরোপুরি ভিন্ন। ফলে গণতন্ত্র নিয়ে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। বাংলাদেশে গণতন্ত্র যথেষ্ট উদার। পশ্চিমারা বাংলাদেশ নিয়ে যে মূল্যায়ন করে, তা যথার্থ নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র থেকে ভারত নেমে এসেছে নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্রের স্তরে। ভারতকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ বলা হয়ে থাকে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটি গত ১০ বছরে ক্রমাগত গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে হাঁটছে এবং সেখানে সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকসমাজের স্বাধীনতা প্রচণ্ডভাবে সংকুচিত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার সঙ্গে এই অবনমনের নিবিড় সম্পর্ক আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়েই স্বেচ্ছাচারী শাসনের প্রভাব বেড়ে চলেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আছে পোল্যান্ডে। করোনা মহামারির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মহামারি সামাল দেওয়ার কথা বলে অনেক দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। তবে অনেক গণতান্ত্রিক দেশ এই সময়টাতে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করার চেষ্টা করেছে। ৯টি দেশে মারাত্মক ও ২৩টি দেশ আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিমিত মাত্রায় লঙ্ঘন করেছে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছে ঘোষিত একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতে, ৫৫টি দেশেই আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছে বেশি।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে শাসনকাঠামোর দিক থেকে নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র এখন সবচেয়ে সাধারণ ধরন। এর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে পুরোপুরি ও আংশিক স্বেচ্ছাতন্ত্রের দেশগুলোতে আছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। অথচ ২০১০ সালে এটি ছিল ৪৮ শতাংশ। আর উদার গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমে হয়েছে ৩২টি। মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ রয়েছে এই দেশগুলোতে। ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি আছে ৬০টি রাষ্ট্রে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ আছে এসব দেশে।
ভি-ডেমের বার্ষিক গণতন্ত্র প্রতিবেদনে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে শীর্ষ তিন স্থানে আছে যথাক্রমে ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় আন্তর্জাতিক নিয়মের মারাত্মক লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে লঙ্ঘন হয়েছে পরিমিত মাত্রায়।
মহামারি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মোট দেশের দুই-তৃতীয়াংশেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক থেকে পরিমিত মাত্রায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ দেশে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ব্যতিরেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করা এবং জরুরি ক্ষমতার অত্যধিক প্রয়োগে বোধ হচ্ছে, কোভিড-১৯ রোগটি গণতন্ত্রের চাকা স্থবির করে দিতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী উদার গণতন্ত্রের ধারাবাহিক অবনমন হচ্ছে। বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া, মধ্য এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায় এ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্রাজিল, ভারত, তুরস্কসহ মোট ১০টি দেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনমন হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি দেশ হয়ে গেছে পুরোপুরি একনায়কতান্ত্রিক।
প্রতিবেদনের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভি-ডেমের মতো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সূচক দিয়ে অবস্থা দেখায়। আমরা তো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজ চোখে দেখছি, অনুভব করছি। আমরা প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিচে নামা প্রত্যক্ষ করছি।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ছিল নির্বাচনসর্বস্ব। এটাও এখন নেই।