চেতনার প্রদীপ জ্বালানো তরুণেরা এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে যে গণজাগরণ শুরু করেছিলেন, তাতে কেঁপেছে পুরো বাংলাদেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছেছিল শাহবাগের প্রতিধ্বনি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রবাসীরাও আন্দোলিত হয়েছিলেন শাহবাগের সঙ্গে।
শাহবাগের সেই আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করাটাও ছিল বিশাল এক অভিজ্ঞতা।
৫ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেদিন সকালে আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ঢাকার কাছেই কেরানীগঞ্জে। কিন্তু ‘কসাই’ কাদেরকে ফাঁসি না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কেরানীগঞ্জের মানুষ। দুপুরের মধ্যেই সেই সংবাদ সংগ্রহ করে ট্রাইব্যুনাল হয়ে চলে এলাম কারওয়ান বাজারে অফিসে। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জানালেন, তাঁরা এই রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগে জড়ো হবেন। বিকেলে ব্লগারসহ কিছু সচেতন মানুষ জাদুঘরের সামনে একটা মানববন্ধনও করলেন। ঘটনাগুলো প্রধান প্রতিবেদক পিন্টু ভাইকে (শরীফুজ্জামান) জানাতেই তিনি বললেন, আলোকচিত্রী নিয়ে শাহবাগে চলে যান।
সন্ধ্যায় শাহবাগে গিয়ে দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মশাল মিছিল বের হচ্ছে। শাহবাগ থেকে বাংলামোটর হয়ে সেই মিছিল আবার ফিরে এল শাহবাগে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে লোকজন ক্রমেই বাড়তে থাকল। রাত নয়টার মধ্যেই হাজার খানেক মানুষ। চারপাশের রাস্তা বন্ধ। শাহবাগের চৌরাস্তায় সবাই বসে স্লোগান দিচ্ছে রায়ের প্রতিবাদে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়েছেন। রাতে যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও। সবার কণ্ঠে একটাই স্লোগান, ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’।
রাত ১২টা বাজে। কিন্তু শাহবাগে তখনো অসংখ্য মানুষ। আয়োজকদের পক্ষ থেকে উপস্থিত সবাইকে বলা হলো, আপনারা আপাতত চলে যান। ভোর থেকে আবার অবস্থান কর্মসূচি হবে। কিন্তু উপস্থিত জনতার একটাই কথা, তাঁরা শাহবাগ ছেড়ে যাবেন না। আমি অফিসে মুঠোফোনে খবরটা দিলাম।
এরপর রাত নামে, রাত পেরিয়ে ভোর। পরদিন সকাল আসে, ভোরের রোদ দুপুরে হয়ে ওঠে প্রখর, আবার বিকেল, সন্ধ্যা, রাত...। প্রকৃতির চক্র বারবার ঘুরে...ক্যালেন্ডারে একেকটি দিন পার হয়। কিন্তু শাহবাগের অবস্থান বদলায় না। মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয় না স্লোগান। সকাল, বিকেল, ভোর, রাত আমি যখনই গিয়েছি, তখনই দেখেছি জনস্রোত। শাহবাগের আন্দোলন চলাকালে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি প্রতিদিন। যত বেশি সম্ভব সেখানে থেকেছি। সন্ধ্যায় অফিসে এসে ঘণ্টা দুয়েক কাজ করে খবর লিখে আবার চলে যেতাম শাহবাগে।
৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার শাহবাগের প্রথম মহাসমাবেশ ছিল। একটি ট্রাক এনে অস্থায়ী যে মঞ্চ বানানো হয়েছিল, আমি তার পাশে ছিলাম। যত দূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। পশ্চিমে কাঁটাবনের মোড়, পুবে মৎস্য ভবন, উত্তরে রূপসী বাংলা হোটেল আর দক্ষিণে টিএসসি ছাড়িয়ে গেছে জনতার সেই ঢল। লাখো জনতা যখন চিৎকার করে সমবেত কণ্ঠে বলছিল ‘জয় বাংলা’; যখন বলছিল ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’; তখন মনে হচ্ছিল, এ বুঝি সত্যিই এক রণাঙ্গন।
সেদিন সমাবেশ শেষ হওয়ার পর প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে অফিসে এসে দ্রুত সংবাদ লেখাটা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। মহাসমাবেশের পর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেল চারটায় তিন মিনিটের জন্য স্তব্ধ কর্মসূচি পালিত হয় শাহবাগে। নীরব সংহতির রেশ না কাটতেই ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কোটি শিখায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে শাহবাগ। লাখো মানুষ যখন মোমবাতি হাতে উঠে দাঁড়ায়, মনে হয়েছিল লাখো তারা আকাশ থেকে নেমে এসেছে ধরায়।
১৫ ফেব্রুয়ারি সমাবেশ থেকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ব্লগার ও স্থপতি রাজীবের জানাজায় উপস্থিত লাখো মানুষ কফিন ছুঁয়ে রাজপথে থাকার শপথ নেয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাওয়া হয় প্রিয় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শাহবাগে ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। আন্দোলনের খবরগুলোতে যেন ভিন্নতা আসে, সে জন্য প্রতিদিনই অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। একদিন ভোররাতে দেখি, এক মা তাঁর ছয় মাস বয়সী শিশুকে কোলে নিয়ে শাহবাগে হাঁটছেন। শীতের রাতে এই শিশুকে নিয়ে বের হয়েছেন কেন জানতে চাইলে সেই মায়ের উত্তর, ‘দাঁড়ান, দেখাচ্ছি।’ এই বলে তিনি ‘তুই রাজাকার’ স্লোগান দিলেন তাঁর শিশুর কানের কাছে মুখ নিয়ে। আর সেই শিশুটি তক্ষুনি মাথা নাড়িয়ে তার জবাব দেওয়া শুরু করল।
কেবল এই শিশুই নয়, যে মানুষটি রাজপথে নামেননি, কখনো স্লোগান দেননি, কখনো মিছিল করেননি, এমন হাজারো মানুষ প্রতিদিন আসতেন শাহবাগে। শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবক-বৃদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা-ছাত্র-শিক্ষক-রাজনীতিবিদ-সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল শাহবাগ। কোনো দল নয়, নেতা নয়, সাধারণ মানুষের জাগরণের এই আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করার অভিজ্ঞতা মনে থাকবে আজীবন।
শরিফুল হাসান: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক