ক্রিকেটে বিশ্বযাত্রা
আমি নিশ্চিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলেরই অনেক ক্রিকেটার বাংলাদেশ ক্রিকেটে আরও বড় সাফল্য এনে দেবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানের গল্প যদি বলা হয় তাহলে প্রথমেই আসবে ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের কথা। আমি সেই দলের একজন সদস্য ছিলাম। সে জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। এর ২০-২২ বছর পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরও একটি বড় অর্জনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলে আমি ছিলাম নির্বাচনদের একজন। অতীতে ফিরে যদি তাকাই, গত এক দশকে তো বটেই, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অর্জন আকবরদের বিশ্বকাপ জয়। আর সেই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। এমন অর্জন খুব মানুষের কপালেই জোটে।
আজ প্রায় দুই বছর হতে চলল। এখনো যেকোনো অনুষ্ঠানে বা কোনো ক্রিকেট আড্ডায় ঘুরেফিরে আসে দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমের ভারতকে ফাইনালে হারানোর গল্প। মাঠে ও মাঠের বাইরের নানা মুহূর্ত যেন এখনো তরতাজা। আমি যদি আরও ১০ বছর পরও এ নিয়ে লিখতে বসি, তখনো হয়তো একই কথাই লিখব। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয় এমনই এক মুহূর্ত।
বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে আমাদের আরেক সাবেক ক্রিকেটার সুজন ভাইয়ের (খালেদ মাহমুদ) অনেক অবদান আছে। আকবরদের দলটাকে তৈরি করতে অনেক কাজ করেছেন তিনি। দুই বছর ধরে অনেক খেলার ব্যবস্থা করেছেন। খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে শক্ত করেছেন। বিদেশি কোচ ও ট্রেনার আনা হয়েছে, যা আগে ছিল না। আমরা যাঁরা খেলোয়াড় বাছাইয়ের কাজে করি, সবাই মিলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে খেলোয়াড় খুঁজে বের করেছি। অনূর্ধ্ব-১৭ থেকেও এখানে নয়জনের মতো খেলোয়াড় ছিল। ওদের অনূর্ধ্ব-১৭-তে থাকা অবস্থায়ই মনে হয়েছিল ওরা বিশ্বকাপ খেলার যোগ্য। একটা দল গড়ার ক্ষেত্রে যেসব বিভাগ কাজ করে, তাদের মধ্যে দারুণ ভারসাম্য ছিল। সেটারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি মাঠে।
এসব ক্ষেত্রে অবশ্য সবাই শেষের ফলটাই মনে রাখে। এর পেছনের পরিকল্পনা ও সেটার বাস্তবায়নের যে প্রক্রিয়া, সেটি খুব একটা আলোচনায় আসে না। যেমন বিশ্বকাপ মাথায় রেখে প্রায় ৪০টির মতো ম্যাচ খেলেছি। আমরা ইংল্যান্ডে খেলেছি, নিউজিল্যান্ডে খেলেছি। এর সবকিছুই দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনের কথা মাথায় রেখেই করা। সে জন্য এই দলের খেলোয়াড়েরাও বেশ ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে। যে কারণে কাজটা সহজ হয়ে যায়। এতগুলো ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাটা ছেলেদের চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেছে।
একসঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলার কারণে ছেলেদের মধ্যে দলগত সংহতি তৈরি হয়েছিল। এ দলটা প্রায় দেড়-দুই বছর ধরে একসঙ্গে ছিল। দল নির্বাচনে ধারাবাহিক ছিলাম আমরা। দু-একটি ছাড়া খুব বেশি পরিবর্তন করতে হয়নি। যে কারণে দলের মধ্যে সম্পর্কটা অনেক মজবুত ছিল। ওদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস ছিল। এ কারণেই আসলে দল বদলাতে হয়নি। আমাদের প্রাথমিক বাছাইটাই শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আমরা একদল বিশ্বকাপজয়ীকে নির্বাচন করতে পেয়েছি।
আকবরদের দলটার আরেকটা ভালো দিক ছিল। মাঠের খেলাটাকে তারা মাঠেই রেখে আসত। পুরো দলে সবাই ছিল সবার বন্ধু। কারও সাথে কারও কোনো মনোমালিন্য ছিল না। এমন একটা দল এমনিতেই ভালো খেলে। সবার মধ্যে একটা আন্তরিকতা কাজ করেছে। কে ভালো করছে, কে খারাপ করছে, এগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। টিম কীভাবে জিতবে, সেটা নিয়েই তাদের বেশি চিন্তা ছিল। আমরা জেতার পরে একসঙ্গে হয়ে ডিনার করতে জেতাম। অনেক মজা করতাম। আমাদের ট্রেনার রিচার্ড স্টনিয়ের চমৎকার একজন মানুষ। তিনি খেলোয়াড়দের খুব হাসিখুশি রাখতেন, মজা করতেন। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, এটা কিন্তু বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের প্রতিযোগিতা। এখানে ছেলেদের স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা খুব জরুরি। কারণ, কেউই কিন্তু একেবারে পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে ওঠেনি। তাই ম্যানেজমেন্ট ছেলেদের স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে দিত।
আকবরদের দলটা এক-দুজনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। যারা যারা ম্যাচ খেলছে একেক দিন একেকজন ম্যাচ বের করে আসছে। কোনো দিন জয়, কোনো দিন তামিম, কোনো দিন আকবর... আবার কোনো দিন শরিফুল-সাকিবরা বোলিং অনেক ভালো করেছে। কেউ না কেউ এগিয়ে এসেছেই। চ্যাম্পিয়ন দল এভাবেই তৈরি হয়। সব বিভাগ থেকেই পারফরম্যান্স আসতে হয়। একজনের ওপর নির্ভর করলে হয় না। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপই তার প্রমাণ। খেয়াল করে দেখবেন, বাংলাদেশ জাতীয় দলও কিন্তু ভালো করলে দল হিসেবেই ভালো করে। একজন-দুজনের পারফরম্যান্সে জেতা ম্যাচ খুব কমই খুঁজে পাবেন। এটাই কিন্তু বাংলাদেশি ধাঁচের ক্রিকেট।
সেই বিশ্বকাপের শুরুর গল্পটা ছিল অদ্ভুত। আমাদের ফেবারিট বলছিল না কেউই। তবে আমরা জানতাম যে আমাদের ফাইনাল খেলার মতো সামর্থ্য আছে। ভাগ্যও আমাদের সঙ্গে ছিল। বিশ্বকাপের প্রথম খেলায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বৃষ্টির কারণে সমীকরণ ছিল কম ওভারে অনেক বেশি রান করতে হবে। সেই ম্যাচে অবিশ্বাস্য ওপেনিং জুটি গড়ে আমাদের জয় এনে দেয় তামিম ও পারভেজ। সেদিন যদি ওভাবে ব্যাটিং না হতো, তাহলে অন্য রকম কিছু হতে পারত। পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলাটি হয়নি বৃষ্টির কারণে। যে কারণে আমাদের সেমিফাইনালে ওঠা সহজ হয়েছিল। আমার ভারতের বিপক্ষে ফাইনালের ম্যাচটার কথা খুব করে মনে পড়ে। ভারতের সঙ্গে ছেলেদের যে শরীরী ভাষা ছিল, সেটা সব সময় স্মৃতিচারণা করতে ভালো লাগে। খেলোয়াড়েরা জেতার জন্য একদম মরিয়া ছিল।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পরের গল্পটাও মনে রাখার মতো। ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয়ের উদ্যাপনটা ১৯৯৭-এর আইসিসি ট্রফি জয়ের উদ্যাপনকে মনে করিয়ে দিয়েছিল। তবে মনে হয় না ’৯৭-এর সেই জয়ের উদ্যাপনের ধারেকাছে কিছু আমরা আর দেখতে পাব। তবু যা দেখেছি, তাতে অবাক হয়েছি। স্টেডিয়ামে মানুষের ঢল নেমেছিল। পুরো দলকে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ছেলেদের বাড়িতে বাড়িতে উদ্যাপন হয়। অনেকে রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে যায়। এক বিশ্বকাপ জয় কত কী না এনে দিল এই ছেলেদের জীবনে। কোভিড না থাকলে হয়তো আরও বেশি সংবর্ধনা পেত। তবে এমন উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলে হয়তো সামনে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট। এবং সেটা এই বিশ্বকাপজয়ী দলের হাত ধরেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আমি নিশ্চিত ওই দলেরই অনেক ক্রিকেটার বাংলাদেশ ক্রিকেটে আরও বড় সাফল্য এনে দেবে। এই যে দেখুন না, শরিফুল-শামীমরা কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে সুযোগ করে নিয়েছেন খুব দ্রুতই। এরা তো কদিন আগেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার ছিল। সামনে আরও অনেকেই আসবে।
● হাসিবুল হোসেন: জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার