ক্যাসিনো-কাণ্ড: দুদকের তালিকায় ২ সাংসদ, ৩ প্রকৌশলী, যুবলীগ নেতাসহ ৪৩ জন
ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িতদের সম্পদ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত নতুন কারও নাম আসেনি। এ পর্যন্ত যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের মধ্যে দুজন সাংসদ, গণপূর্তের সাবেক তিনজন প্রকৌশলী ও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন। এদের প্রায় সবারই নাম ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে নানাভাবে এসেছে।
যে ৪৩ জনের নামে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাঁদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বেশ কিছু সম্পদের তথ্য দুদকের হাতে এসেছে। মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম প্রকল্পে’ সম্রাটের অংশ নেওয়া, সেখানে বাড়ি কেনা ও ব্যাংক লেনদেনের যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলো নিয়ে বেশ আগেই তারা অনুসন্ধান করেছিল।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের সম্পদ ও অর্থ পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করে দুদক। মূলত গণমাধ্যমে আসা তথ্য নিয়েই তারা কাজ শুরু করে। দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত সোমবার জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তাঁরা।
তবে অনুসন্ধান সূত্র জানিয়েছে, এ তালিকায় প্রতিদিনই নতুন নাম ঢুকছে। প্রাথমিকভাবে গণমাধ্যমের তথ্য নেওয়া হলেও এখন দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করছেন দুদক কর্মকর্তারা।
সোমবার পর্যন্ত দুদকের অনুসন্ধান তালিকায় ভোলা-৩ আসনের সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এবং জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ শামশুল হক চৌধুরীর নাম আছে। ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করার পাঁচ দিনের মাথায় শাওন ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে অভিযান শুরু হওয়ার কয়েদিন পর চট্টগ্রামে অভিযান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হুইপ শামশুল।
দুদকের অনুসন্ধান তালিকায় রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের নাম। ঠিকাদার ও যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের কথা গণমাধ্যমে এসেছে। এর আগে রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে দুদকে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকলেও তা খুব এগোয়নি। দুদকের তালিকায় থাকা অন্য নামগুলোর মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ঠিকাদার জি কে শামীম, শামীমের স্ত্রী শামীমা সুলতানা, মা আয়েশা খাতুন, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি ও ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট ও এনামুল হক ওরফে আরমান, যুবলীগের বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ ও হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক ও তাঁর ভাই থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা সভাপতি শফিকুল ইসলাম ওরফে ফিরোজ, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূইয়া ও অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান অন্যতম।
এঁদের মধ্যে জি কে শামীম, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান, শফিকুল ইসলাম, লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও সেলিম প্রধান র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
গোয়েন্দা তথ্য সহায়তা নিচ্ছে দুদক:
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের সঙ্গে গত বুধবার বিশেষ বৈঠক হয়েছে দুদক চেয়ারম্যানের। পরদিনই বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইউ) প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসানও বৈঠক করেছেন দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। দুই বৈঠকে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের নানা গোয়েন্দা তথ্য হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, অভিযানে র্যাব যাদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে কারা কারা যুক্ত এবং কারা এর সুবিধাভোগী ও পৃষ্ঠপোষক তাদের সম্পর্কে পাওয়া তথ্য দুদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএফআইইউ প্রধানও দুদকের কাছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেনসহ নানা বিষয়ে তথ্য দুদক চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করেন।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, বিএফআইইউ এবং র্যাবের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের পাওয়া তথ্যও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এরপরই বোঝা যাবে, অনুসন্ধানের আওতায় কতজন আসছেন। তবে এ তালিকা যে দীর্ঘ হবে তা জানিয়ে দিলেন অনুসন্ধান সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে দুদক সচিব দিলোয়ার বখ্ত বলেন, অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন কিংবা অর্থ পাচারের বিষয়ে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে সে বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। এ পর্যন্ত ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।