ঢাবি শিক্ষার্থী খুনের বিচার শেষ হয়নি ৪৩ বছরেও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ১৯৭৭ সালে খুন হয়েছিলেন ভূতত্ত্ব বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র বীরেন্দ্র কুমার। অভিযোগ ওঠে, প্রেমসংক্রান্ত বিরোধের জেরে রণজিৎ কুমার মজুমদার নামে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্র তাঁকে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় হত্যা মামলা হলেও আসামি কখনো গ্রেপ্তার হননি। শেষ হয়নি বীরেন্দ্র হত্যার বিচারও।
আদালত সূত্র ও মামলার নথিপত্র থেকে জানা গেছে, বীরেন্দ্র হত্যাকাণ্ডের পর গত ৪৩ বছরে ওই মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন ৩৪ জন বিচারক। শুনানি হয়েছে ২৬৫ কার্যদিবস। এর মধ্যে মামলার আট সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনজন। বাদীসহ বাকি পাঁচ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। বছরের পর বছর রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করার জন্য আদালতের কাছে সময় চেয়ে আবেদন করে চলেছে। আর সাক্ষী হাজির করতে অন্তত পাঁচবার পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট থানায় চিঠি পাঠিয়েছেন আদালত। অনুপস্থিত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে এক আদেশে আদালত বলেছেন, সাক্ষীদের হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষ আন্তরিক নয়। এভাবে চলতে পারে না।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ও আদালতের এমন বক্তব্যের পরও এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে না। এই বিচারকার্যে বিলম্বের বিষয়টি নজরে আনা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, এই মামলাটির বিচারে কেন এত বিলম্ব, তিনি খোঁজ নেবেন ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।
মামলাটি পাঁচটি আদালত ঘুরে বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এ বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) রফিক উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাক্ষীর অভাবে বীরেন্দ্র কুমার হত্যা মামলাটির নিষ্পত্তি হচ্ছে না। অবশিষ্ট সাক্ষীদের হাজির করতে আমাদের আদালত থেকেও বারবার পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সাক্ষীদের হাজির করা হচ্ছে না।’
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. জাফর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তিনি খোঁজখবর নেবেন। আদালতের আদেশ অনুযায়ী সাক্ষীদের হাজির করানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
মামলায় যে পাঁচজন সাক্ষ্য দেননি, তাঁরা হলেন জগন্নাথ হলের তৎকালীন আবাসিক শিক্ষক জপব্রত চৌধুরী, হলের তৎকালীন আবাসিক ছাত্র স্বপন কুমার রায়, সচিন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, শীষ মোহাম্মদ ও রমনা থানার তৎকালীন এএসআই ও মামলার রেকর্ডিং অফিসার আবদুল বারী। পুলিশ আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলেছে, বাদী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। বাকি সাক্ষীদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
তদন্তে উঠে আসে, শিলা নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তখন রোকেয়া হলে থাকতেন। রণজিতের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। পরে বীরেন্দ্রর সঙ্গে শীলার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি রণজিৎ। তাই পরিকল্পনা করে একদিন জগন্নাথ হলে বীরেন্দ্রকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান রণজিৎ।’ রণজিতের বাড়ি নোয়াখালীতে। খুনের পর ভারতে পালিয়ে যান তিনি
বীরেন্দ্র খুনের নেপথ্যে
বীরেন্দ্র ও রণজিৎ উভয়েই থাকতেন জগন্নাথ হলে। একই বিভাগের ছাত্রও ছিলেন দুজন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্তে উঠে আসে, শিলা নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তখন রোকেয়া হলে থাকতেন। রণজিতের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। পরে বীরেন্দ্রর সঙ্গে শীলার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি রণজিৎ। তাই পরিকল্পনা করে একদিন জগন্নাথ হলে বীরেন্দ্রকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান রণজিৎ।’ রণজিতের বাড়ি নোয়াখালীতে। খুনের পর ভারতে পালিয়ে যান তিনি।
হত্যাকাণ্ডের পর রণজিতের নামে জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক জপব্রত রায় চৌধুরী রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হলের উত্তর পাশের দোতলায় সিঁড়িতে সন্ধ্যার সময় বীরেন্দ্রকে ছুরিকাঘাত করা হয়। তখন গুরুতর জখম বীরেন্দ্র চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘রণজিৎ আমাকে মেরে ফেলল।’ পরে হলের তৎকালীন আবাসিক ছাত্র স্বপন কুমার রায় বীরেন্দ্রকে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক বীরেন্দ্রকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিচারে ধীরগতি, দায় কার
বীরেন্দ্র খুন হওয়ার মাত্র দুই মাস পর (১৯৭৭ সালের ১ ডিসেম্বর) রণজিতের নামে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় রমনা থানা-পুলিশ। মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, এর ১১ বছরের মাথায় ১৯৮৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রণজিতের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের ২১ বছর পর (২০০৯ সালের ৩ আগস্ট) মামলার দুজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। তাঁরা হলেন জগন্নাথ হলের তৎকালীন আবাসিক ছাত্র সজল কান্তি মণ্ডল ও আশিস কুমার পাল।
এই দুজন সাক্ষ্য দেওয়ার পাঁচ বছর পর (২০১৪ সালের ৩ জুলাই) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই খোরশেদ আলম আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর গত ছয় বছরে একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, ৪৩ বছর আগের বীরেন্দ্র কুমার হত্যা মামলার বিচার আটকে আছে—বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। মামলাটির বিচার যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ফৌজদারি মামলায় দীর্ঘসূত্রতা বা বিচার শেষ না হওয়ার পেছনে মূলত দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সাক্ষীকে হাজির করার দায়িত্ব তাদের। বিচারক সাক্ষীদের ধরে আনবেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাক্ষীদের হাজির না করলে বিচার শেষ হয় না
২১ বছর আগে (১৯৯৯) এক আদেশে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, বীরেন্দ্র খুনের মামলাটি একটি পুরোনো মামলা। সাক্ষীদের প্রতি বারবার সমন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হচ্ছে। কিন্তু প্রসিকিউশন পক্ষ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে সক্ষম হয়নি। ১৯৮৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আদালতের আদেশ আইজিপিকে পাঠানো হয়। আবার ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আদালতের আদেশ ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনারকে পাঠানো হয়। সাক্ষী হাজির না করায় বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হলে এর দায় পুলিশের।
বিচারের এই শম্বুকগতির বিষয়ে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৩–এর পেশকার আরিফুর রহমান বলেন, ৪৩ বছরের পুরোনো খুনের মামলার নথিপত্রটি সাবধানে রাখতে হচ্ছে। কারণ মামলার কাগজগুলো এতই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে যে তা ধরলে ছিঁড়ে যাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারি মামলায় দীর্ঘসূত্রতা বা বিচার শেষ না হওয়ার পেছনে মূলত দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সাক্ষীকে হাজির করার দায়িত্ব তাদের। বিচারক সাক্ষীদের ধরে আনবেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাক্ষীদের হাজির না করলে বিচার শেষ হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই দিকটার ব্যাপারে কেউ কখনো নজর দিয়েছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে জবাবদিহি না থাকলে ফৌজদারি মামলার ভিকটিম ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন।