কিশোর মিলন হত্যায় ৪ পুলিশকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র

পুলিশ গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে। এরপর পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতেই সমানে কিলঘুষি, লাথি ও লাঠিপেটা। উন্মত্ত জনতার পিটুনিতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ছেলেটির। আট বছর আগের এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ সদস্যদের অব্যাহতি দিয়ে আসামি করা হয়েছে অন্যদের।

২০১১ সালের ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চর কাঁকড়া এলাকায় কিশোর মিলনকে ‘ডাকাত’ সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে তুলে দেওয়ার পর পিটিয়ে হত্যার ভিডিও চিত্র দেখে তখন স্তম্ভিত হয়ে পড়ে প্রশাসনসহ সাধারণ মানুষ।

গত ৯ মার্চ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মদ নোয়াখালীর ২ নম্বর আমলি আদালতে পাঁচ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্র দাখিল করেন, যাতে চর কাঁকড়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন সদস্য জামাল উদ্দিন, তাঁর সহযোগী মিজানুর রহমান ওরফে মানিকসহ ২৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮ জন জামিনে, আর বাকি ২০ জন পলাতক। অভিযোগপত্র তৈরি ও দাখিলের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়েছে মামলার বাদী মিলনের মা কোহিনুর বেগমের অগোচরে। আজ ২৭ জুলাই মিলন হত্যার আট বছর পূর্ণ হচ্ছে।

বাদী কোহিনুর প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গে সিআইডির কোনো যোগাযোগ নেই। টাকাপয়সার অভাবে তিনি মামলার খোঁজ নেওয়ার জন্য আদালতেও যেতে পারেননি। এখন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।

পুলিশকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়ে জানার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন আহম্মদকে ফোন দেওয়া হলে তাঁর মেয়ে ফোন ধরে বলেন, তাঁর বাবা ৮ জুলাই হজে গেছেন। সিআইডির নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামালকে বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

শামছুদ্দিন মিলন
শামছুদ্দিন মিলন

ঘটনার সময় নোয়াখালীর পুলিশ সুপার ছিলেন হারুন উর রশীদ হাযারী। এখন তিনি চট্টগ্রামের উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক)। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাটিকে একটা পর্যায়ে রেখে এসেছিলাম। প্রাথমিকভাবে দায়ী পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। এরপর কী ঘটেছে, তা জানা নেই। যদি এমন কিছু ঘটে থাকে, তাহলে বলব বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।’

অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে জেলা জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রসুল প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্রে পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার দায়ে ‘গুরুদণ্ড’ (সাময়িক বরখাস্ত) দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। তারপরও তাঁদের এ মামলায় আসামি না করার কোনো কারণ তিনি দেখছেন না।

তাঁরা স্বপদে বহাল

ভিডিও চিত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে কোম্পানীগঞ্জ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিক উল্লাসহ চার পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিছুদিন পরই তাঁরা আবার স্বপদে ফিরে যান। আর ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা তিন পুলিশ সদস্যকে বিভাগীয় মামলায় পৃথক দণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে এসআই আকরাম উদ্দিন শেখকে তিন বছরের জন্য এবং কনস্টেবল হেমারঞ্জন চাকমা ও আবদুর রহিমের দুই বছরের জন্য স্থায়ীভাবে বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছিল। সিআইডির অভিযোগপত্রে এই শাস্তিকে ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তিন পুলিশ সদস্যকে কেন এ মামলায় আসামি করা হয়নি, সে বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই।

>

‘ডাকাত’ সাজিয়ে পুলিশ ছেলেটিকে জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল
৪ পুলিশ সদস্য বরখাস্ত হলেও এখন তাঁরা বহাল

মিলনের বাড়ি কোম্পানীগঞ্জের চর ফকিরা গ্রামে। বাবা প্রবাসী গিয়াস উদ্দিন। মিলন ২০১০ সালে স্থানীয় কবি নজরুল উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও অর্থের অভাবে এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি। সেদিন বাবার পাঠানো ১৪ হাজার টাকা নিয়ে জমি রেজিস্ট্রির জন্য উপজেলা সদরে যাওয়ার পথে এক খালাতো বোনের সঙ্গে দেখা করতে চর কাঁকড়া ব্যাপারী স্কুলের মসজিদের ঘাটে অপেক্ষা করছিল। কিছুক্ষণ পর সেখানে ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন ও সহযোগী মিজানুর রহমান তার পরিচয় জানতে চান। তাঁরা পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরও সঙ্গে থাকা মুঠোফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে মিলনকে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে পুলিশ থানায় নেওয়ার পথে তাঁকে ‘ডাকাত’ সাজিয়ে টেকেরবাজারে উন্মত্ত জনতার হাতে ছেড়ে দেয়।

পাঁচ কর্মকর্তার তদন্ত

২০১১ সালের ৩ আগস্ট মিলনের মায়ের পিটিশন মামলাটি আদালত থেকে কোম্পানীগঞ্জ থানায় যাওয়ার পর প্রথমে থানা-পুলিশের একজন, পরে ডিবি পুলিশের চারজন কর্মকর্তা তদন্ত করেন। ডিবির সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা (ওসি, ডিবি) মো. আতাউর রহমান ভূঁইয়া ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে তিনি পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব দেখিয়েছিলেন।

২০১১ সালের ২৭ জুলাই। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের গাড়ি থেকে উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে।  ফাইল ছবি
২০১১ সালের ২৭ জুলাই। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের গাড়ি থেকে উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে। ফাইল ছবি

এ নিয়ে ওই বছরের ২৭ জুলাই ‘বিচার মাটিচাপা দিল পুলিশ’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। কোহিনুর বেগমও আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। পরে ৫ নভেম্বর ২ নম্বর আমলি আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফারহানা ভূঁইয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সিআইডি দীর্ঘ প্রায় তিন বছর চার মাসের তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিল।

আইনজীবীর বক্তব্য

বাদীপক্ষের আইনজীবী কল্পনা রানী দাস বলেন, পুলিশ মিলনকে চিকিৎসা না করিয়ে জনতার হাতে তুলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল। বাদীর এ অভিযোগ সিআইডির অভিযোগপত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, আগামী ১৯ আগস্ট মামলার পরবর্তী তারিখে দাখিল করা অভিযোগপত্র বিবেচনার জন্য রাখা হয়েছে। ওই তারিখে অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হবে, না নতুন করে তদন্তের জন্য দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে।

জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি এ টি এম মহিব উল্যাহ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মামলাটি এখনো আমলি (ম্যাজিস্ট্রেট) আদালতে রয়েছে। তবে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর পুলিশ তাঁর কাছে এ বিষয়ে মতামত চেয়েছিল। তিনি তখন তাদের ভিডিও চিত্র দেখে যাচাই-বাছাই করে যাঁরা দোষী, তাঁদের শনাক্ত করে আসামি করার পরামর্শ দেন।