>পুলিশ বলছে, ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বৈঠকে অচেতন না হওয়া পর্যন্ত কিশোরদের পেটানোর সিদ্ধান্ত হয়
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) গত বৃহস্পতিবার সকালে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রের ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কেন্দ্রের প্রধান প্রহরীকে আঘাত করা কিশোরদের পেটাতে হবে অচেতন না হওয়া পর্যন্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একে একে ১৮ কিশোরকে আবাসিক ভবন থেকে ধরে আনা হয়। এরপর তাদের দুই হাত জানালার গ্রিলের মধ্যে আটকে, পা বেঁধে ও মুখে গামছা গুঁজে দিয়ে রড এবং ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়। এতে মারা যায় ৩ কিশোর, গুরুতর আহত হয় ১৫ জন। সেদিন দুপুরে তাদের খেতেও দেওয়া হয়নি।
যশোর জেলা পুলিশ আজ শনিবার আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে শিশু নির্যাতনের এমন বর্ণনা দেন পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন।
বৃহস্পতিবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নাঈম হোসেন (১৭), রাসেল ওরফে সুজন (১৭) ও পারভেজ হাসান (১৭) নামের তিন কিশোর নিহত হয়। প্রথমে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রের ভেতরে কিশোরদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে তারা মারা যায়।
কিশোরদের ভাষ্য অনুযায়ী, ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) তাঁর চুল কেটে দিতে বলেন এক কিশোরকে। ওই কিশোর চুল কেটে না দেওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগাল করলে কয়েক কিশোর মিলে নূর ইসলামকে মারধর করে। এর জের ধরে এই ঘটনা ঘটে।
গতকালের সংবাদ ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ওই বৈঠকে উপস্থিত ১৯ জনকে গত শুক্রবার দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচ কর্মকর্তাকে তিন কিশোর হত্যার দায় নিতেই হবে। এ জন্য কেন্দ্রের শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তাকে কিশোর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার কর্মকর্তারা হলেন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক (প্রবেশন অফিসার) মাসুম বিল্লাহ, কারিগরি প্রশিক্ষক মো. ওমর ফারুক, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর এ কে এম শাহানূর আলম ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান। গতকাল তাঁদের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানায় পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত প্রথম তিনজনের পাঁচ দিনের ও পরের দুজনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেন বলেন, কেন্দ্রের কিশোরদের মারধরের ঘটনা ঘটে বেলা একটার দিকে। গুরুতর আহত কিশোরদের সারা দিন চিকিৎসা ছাড়া ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যায় নাঈম নামের এক কিশোর মারা গেলে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। তখনো কেন্দ্র থেকে কোনো তথ্য কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে সিভিল সার্জন ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেখানে যায়। তখন কিশোরদের ডরমিটরিতে গিয়ে দেখা যায়, মুমূর্ষু অবস্থায় অনেক কিশোর পড়ে আছে। তাদের পুলিশের পিকআপ ভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে আরও দুই কিশোর মারা যায়। পুলিশ সুপার বলেন, পিটুনিতে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফিরলে আবার তাদের পেটানো হয়।
পুলিশ সুপারের সভাকক্ষে ব্রিফিংয়ের সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলামসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় নিহত কিশোর পারভেজ হাসানের বাবা খুলনার দৌলতপুর উপজেলার মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রোকা মিয়া যশোর কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তবে এজাহারে আসামিদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এর মধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক মো. নূরুল বাসির বলেন, আবদুল্লাহ আল মাসুদকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অন্যদের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নূরুল বাসিরের নেতৃত্বে সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি দল তদন্ত শুরু করেছে। এ ছাড়া যশোর জেলা প্রশাসনের তিন সদস্যের আরও একটি কমিটি তদন্তের জন্য মাঠে নেমেছে। এদিকে তিন কিশোরের মৃত্যুর ঘটনায় তথ্যানুসন্ধানের জন্য গত শুক্রবার দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।