করোনায় পরিবর্তিত বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে
আমরা একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই যুদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের নয়। রাষ্ট্রর সঙ্গে রাষ্ট্রের নয়। একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস সবার সমান শত্রু। সারা মানবজাতির জন্য এটা একটা উপযুক্ত সময় ছিল সারা পৃথিবী একত্র হওয়ার। বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো।
জাপানি সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ইউচি ফুনাবাসী (Yoichi Funabashi) মনে করেন, করোনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র, যার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে রাষ্ট্রগুলোর উত্থান ও পতন। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্ধারিত হবে কাদের অবস্থান অধিক টেকসই।
করোনাভাইরাসের ভয়ংকর থাবায় পৃথিবীর সব জনপদ লোকালয় বিধ্বস্ত।
অর্থনীতির চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থা। যে সরকারগুলো অনেক দক্ষতার সঙ্গে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে, তার মধ্যে অন্যতম প্রাচ্যের সরকারগুলো। পাশ্চাত্য শক্তি বলে জিগির করা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে ওয়েস্টার্ন ব্র্যান্ড (western Brand), তার ধস নেমেছে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায়। ধ্বংসাত্মক সমরাস্ত্র নিয়ে ভয় দেখিয়ে গোটা বিশ্বকে যে দাপিয়ে বেড়ায়, অথচ সে তার সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করতে পারেনি। এর থেকে বড় লজ্জা আর নেই।
প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের একাডেমি সিয়ানদের প্রায় অভিন্ন মত, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এক নতুন ধরনের বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অনেকে মনে করেন, করোনাভাইরাস বিশ্ব ব্যবস্থা পরিবর্তনে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনবে না, তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক যুদ্ধ যা আগেই শুরু হয়েছিল, সেটাকে ত্বরান্বিত করবে অধিকন্তু চীনকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের দিকে।
বর্তমান যে বিশ্ব ব্যবস্থায় আমরা অবস্থান করছি, তাকে বলা যায় তথাকথিতে উদারনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থা, যার নেতৃত্বে আছে যুক্তরাষ্ট্র ।এর উত্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে। প্রধানত ব্রিটিশ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এক নীলনকশা তৈরি করে। আটলান্টিক চার্টার ছিল সেই নীলনকশার অংশ। ন্যাটো, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই এম এফ, গ্রুপ সেভেন, বিশ্ববাণিজ্য প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সুসংহত করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তাদের অনেক বাধা দূর হয়ে যায়।
গত কয়েক দশকে চীন ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে উঠে এসেছে। বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে তার জোরালো ভূমিকা দেখা যায়। বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টর মাধ্যমে এসব অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিলিয়নস ডলারের বিনিয়োগ করেছে। সামরিক সরঞ্জামের দিক দিয়ে চীন আগের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। বাণিজ্যযুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে বিরোধ এমন একপর্যায়ে যে এটা আর মীমাংসা হওয়ার নয়। চীনকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের একটা বাস্তবতা করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে Western Brand অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যে বিশ্ব ব্যবস্থা, তা এখন পতনশীল। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকুচিত। তারা তাদের সাধারণ নাগরিকদের তো সুরক্ষা দিতেই পারেনি, বরং তাদের অপারগতার দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপাতে চাইছে।
বিশ্বযুদ্ধের জয়ের মতোই এই করোনাযুদ্ধে যারা জয়ী হবে, তারাই নেতৃত্ব দেবে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাপনার। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চীনের সফলতা অনেক বেশি। শুধু তা-ই নয়, চীন তার অর্থনৈতিক চাকা সচল করে করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় নিয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে পরিবর্তনগুলো প্রধানত নিম্নরূপ—
১.
বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যমুখী ত্বরান্বিত হবে।
২.
অতিমাত্রর বিশ্বায়ন ধারণার ঘাটতি দেখা দেবে।
৩.
রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী হবে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায়।
৪.
সব ধরনের সরকার রাষ্ট্রের নিম্ন কাঠামো শক্তিশালী করবে এবং সংকট মোকাবিলায় জরুরি ব্যবস্থাপনা বহুগুণে বৃদ্ধি করবে।
৫.
করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ সরকারগুলো ক্ষমতাচ্যুত হবে।
সর্বোপরি এটা বলা যায়, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাপনা এখন অবশ্যম্ভাবী।
ভারত এখনো পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। ভারতের উচিত হবে না কারও ফাঁদে পা দিয়ে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ থেকে দূরে থাকা।
বাংলাদেশের এখন উচিত হবে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার অগ্রগামী দেশগুলোর সঙ্গে আগে থেকেই সম্পৃক্ত হয়ে নতুন ব্যবস্থাপনার ব্লুপ্রিন্টের অংশীদার হওয়া।
*লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক