এবার ভোটের পালা...

বাংলামোটরে সেনাবাহিনীর তল্লাশি। ছবি: সাজিদ হোসেন
বাংলামোটরে সেনাবাহিনীর তল্লাশি। ছবি: সাজিদ হোসেন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার ও গণসংযোগ শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা ভোটের। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদের ২৯৯টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন এসব আসনের প্রায় ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটার। এ দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোট গ্রহণ করা হবে।

বিএনপি মনোনীত প্রার্থী টি আই এম ফজলে রাব্বী চৌধুরীর মৃত্যুতে গাইবান্ধা-৩ আসনের ভোট আপাতত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এই আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে ২৭ জানুয়ারি।

আজ শুক্রবার সকাল ৮টায় ভোটের প্রচার শেষ হয়েছে। চলছে ভোটের শেষ মুহূর্তের প্রচার। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীও মাঠে রয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচনী সামগ্রী পাঠানো শুরু হয়েছে। সড়ক, মহাসড়কে সতর্ক রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে গঠিত আওয়ামী লীগের জোটের নাম মহাজোট। এই জোটে আরও আছে বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং ক্ষমতাসীনদের সমমনা আরও কিছু দল। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আছে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, এলডিপি, জেএসডি এবং অনিবন্ধিত জামায়াতে ইসলামী ও নাগরিক ঐক্য।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বারবার বলে যাচ্ছেন, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। অবশ্য এবারের নির্বাচনের প্রচারের সময় দেশের অর্ধেক আসনে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সরকারবিরোধী দলগুলোর ১৩ জন সাংসদ হামলার শিকার হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে মোট সহিংসতার ঘটনা শতাধিক।

এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে ক্ষমতাসীন জোট সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাঁরা নির্বাচনে প্রচার চালিয়েছে বাধাহীনভাবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের প্রার্থীদের প্রচার উপকরণ এবং গানে গানে মুখর ছিল সারা দেশ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাঁদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো অভিযোগও নেই। এই জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ ২৫৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বাকি আসনে আছে শরিকেরা।

বাংলামোটরে সেনাবাহিনীর তল্লাশি। ছবি: সাজিদ হোসেন
বাংলামোটরে সেনাবাহিনীর তল্লাশি। ছবি: সাজিদ হোসেন

ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে সারা দেশে বিরোধী শিবিরের প্রার্থীদের প্রচার উপকরণ তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। চোখে পড়ার মতো ছিল না তাঁদের মিছিল সমাবেশ। উল্টো প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় জর্জরিত আছে দলটির প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকেরা। অভিযোগ আছে, ভোটের দিন দলটির এজেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালনের জন্য নির্বাচিতদের তালিকা ধরে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

১০ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও তাদের শরিকদের অর্ধ-শতাধিক প্রার্থী প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ১৩ জন প্রার্থীকে শারীরিকভাবে জখম করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রার্থীরা হলেন—ঢাকা-৩ আসনের গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ঢাকা-৪ আসনের সালাউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা-৬ আসনের সুব্রত চৌধুরী (গণফোরাম), ঢাকা-৮ আসনের মির্জা আব্বাস, ঢাকা-৯ আসনের আফরোজা আব্বাস, নোয়াখালী-১ আসনের মাহবুব উদ্দিন, পাবনা-৪ আসনের হাবিবুর রহমান হাবিব।

এখন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী আইনি জটিলতার কারণে বিএনপির ২১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। তবে ভোটগ্রহণ শুরুর আগ পর্যন্ত এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, কমতেও পারে।

বিএনপি শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে, নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন সরকারি দলের পক্ষে কাজ করছে, বিশেষ করে পুলিশ ও জনপ্রশাসন বিভাগ। কিন্তু ইসি তাদের অভিযোগ তেমন একটা আমলে নেয়নি। দুজন জেলা প্রশাসক (নাটোর ও গাইবান্ধা), একজন পুলিশ সুপার (নারায়নগঞ্জ), একজন পুলিশ কমিশনার (খুলনা), একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ফরিদপুর) এবং কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করে তাঁরা দায় সেরেছে।

ইসির আইন শাখা সূত্র জানায়, বিএনপির কিছু কিছু অভিযোগ নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো হলেও কমিটি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। যদিও এসব অভিযোগের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিএনপি থেকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছিল।

এসব অভিযোগকে কেন্দ্র করেই গত মঙ্গলবার দুপুরে সিইসি কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এদিন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা চারজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এই চার কর্মকর্তা হলেন-কেরানীগঞ্জের একজন সাব-ইন্সপেক্টর, ঢাকার ডিবি পুলিশের একজন ওসি এবং কুমিল্লার মুরাদনগর ও নাঙ্গলকোট থানার ওসি। কিন্তু সিইসির কাছে কোনো আশ্বাস না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের নেতারা অভিযোগপত্র জমা না দিয়েই সভা ত্যাগ করেন। একই দিন বিকেলে ঐক্যফ্রন্ট সিইসি কে এম নূরুল হুদার পদত্যাগ দাবি করে। এই ঘটনার পর থেকে ঐক্যফ্রন্ট ইসিতে কোনো অভিযোগ নিয়ে যায়নি। অথচ তার আগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই ইসিতে বিএনপি নেতাদের যাতায়াত ছিল।

নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইসি নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু এখনো সময় আছে, ইসির উচিত সবার সঙ্গে সমান আচরণ করা। সিইসির সঙ্গে ড. কামালের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় প্রসঙ্গে সাবেক এই কমিশনার বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। তবে নির্বাচনের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে নিয়মিত ইসিতে যেতে হবে।

ভোটের আরও তথ্য

এবারের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৩ জন। এদের মধ্যে নারী ভোটার ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১১ এবং পুরুষ ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬২ জন। নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দায়িত্ব পালন করবেন ৪০ হাজার ১৮৩ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩১৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৩২ জন পোলিং অফিসার।

এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের ৬টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হবে। এসব আসন হলো—রংপুর-৩, খুলনা-২, সাতক্ষীরা-২, ঢাকা-৬ ও ১৩ ও চট্টগ্রাম-৯। এসব আসনের ভোটার সংখ্যা ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪ জন। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৮৪৫ এবং কক্ষের সংখ্যা ৫ হাজার ৩৮ টি।

এর বাইরে নির্বাচনী অনিয়ম তদন্তের জন্য আছে ২৪৪ জনের সমন্বয়ে গড়া ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি। নির্বাচনী অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচার কাজ পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬৪০ জন বিচারিক হাকিম ও ৬৫২ জন নির্বাহী হাকিম।