চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে কোনো চমক নেই। এ রকম একটা ফলাফল হবে—এটা যেন সবাই জানত। ভোটের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট, নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অনুপস্থিতি আর আওয়ামী লীগের কর্মীদের সক্রিয় সরব উপস্থিতি এবং সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই চট্টগ্রামের মানুষ ভোটের দিনই বলে দিয়েছে, ‘রেজাউলতো অই যাইবু, এতিক্ষিন টঁসা গরিবার হনো দরহার আছিল না (রেজাউল তো হয়ে যাবে। এত তামাশার দরকার ছিল না)।’
তামাশা বলতে আসলে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়াকেই বোঝাতে চেয়েছে মানুষ। শেষ পর্যন্ত মানুষ যা ভেবেছে তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন পেয়েছেন মাত্র ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট। শুধু মেয়র নয়, গতকালের নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর ৪০ জনের মধ্যে সব কটি জিতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি একটি ওয়ার্ডও পায়নি। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোতেও বিএনপির কোনো প্রার্থী জেতেননি। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিম মারা যাওয়ায় ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের ভোট হয়নি।
৪০টি ওয়ার্ডে নির্বাচনের ফলাফলে যা কিছু চমক সেটি হলো আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে সাতজনের জয়লাভ। দলের চোখরাঙানি, নানা শাস্তির হুমকি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে থেকে ভোটে জিতেছেন ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের সাহেদ ইকবাল বাবু, ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের শফিকুল ইসলাম, ৯ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের মো. জহুরুল আলম জসিম, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডের মো. ইলিয়াস, ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডের হাসান মুরাদ বিপ্লব এবং ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের মোরশেদ আলী। ১, ২, ৩ সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী ফেরদৌস বেগম মুন্নিও জিতেছেন।
এবারের নির্বাচনে যা কিছু উদ্বেগ, উত্তেজনা, আলোচনা, গুজব, গুঞ্জন ছিল তা এই বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে। দলের উচ্চপর্যায়ের কোনো কোনো নেতার গোপন সমর্থনও পেয়েছেন তাঁরা। সেই গোপন সমর্থন তাঁদের উসকে দিয়েছে। তাঁদের বিরোধের কারণেই এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন রক্তে রঞ্জিত হলো। কলঙ্কিত হলো চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ইতিহাস। গত ২৭ বছরের ইতিহাসে এমনটি দেখা যায়নি। এর আগে ১৯৯৪, ২০১০ এবং ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের দিন কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। অথচ গতকাল নির্বাচনের দিন সহিংসতায় প্রাণ গেছে রাজমিস্ত্রি আলাউদ্দিনের। সরাইপাড়ার নিজাম উদ্দিন মুন্না নামে আরও একজন যুবলীগের কর্মী খুন হয়েছেন তাঁর বড় ভাইয়ের হাতে।
বড় ভাইয়ের নাম সালাউদ্দিন কামরুল। পুলিশ বলছে, পারিবারিক কলহের জের ধরে মুন্না খুন হয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থন নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। এই দ্বন্দ্বের জের ধরেই তাঁর মৃত্যু।
এর আগে ৮ জানুয়ারি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার চার দিন পর ১২ জানুয়ারি পাঠানটুলির বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের এবং আরেক প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের মধ্যে দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন কাট্টলি মহল্লার সরদার আজগর আলী। মৃত্যুর তালিকা এখানেই শেষ নয়। অনেকের মনে না থাকলেও তানভীর আহমদের পরিবারে এখনো মাতম থামেনি। করোনার কারণে ভোট স্থগিত হওয়ার আগে প্রচারণার সময় কাট্টলীতে মারা যান তানভীর আহমদ।
এই সব খুনোখুনির কারণে অনেকে কারাগারে আছেন, অনেকের বিরুদ্ধে আছে মামলা। গতকাল আহত হয়েছেন অনেকেই। এসব কারণে বিপন্ন তাঁদের জীবনও।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্র দখলে ছিল, তাদের পক্ষে ভোট গিয়েছে বেশি। মারামারি ও খুনোখুনিও করেছেন তাঁরা। এসব দেখে চট্টগ্রামের মানুষের মন্তব্য, ‘ইতারা ইতারা ভাগেজোগে হার, মাঝোদি মার হোল হালি অই গেল (ওরা ওরা ভাগাভাগির টানাপোড়েনে পড়ে কিছু মায়ের কোল খালি হলো)।’
সব মিলিয়ে খুব একটা সুখকর হয়নি ২০২১–এর এই সিটি নির্বাচন। নবনির্বাচিত মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, চট্টগ্রামকে স্বপ্নের শহরে পরিণত করতে যা যা প্রয়োজন, তিনি তা করবেন। কিন্তু যে কটি মানুষ তাদের স্বজনকে হারিয়েছে, তাদের দুঃস্বপ্ন থেকে কে ফিরিয়ে আনবে!