কালজয়ী কথাশিল্পী, বরেণ্য চলচ্চিত্রকার, প্রগতিপথের নির্ভীক যাত্রী জহির রায়হানের ৩৭ বছরের জীবন যেন এক মহাজীবনের আলেখ্য। এই মহাজীবনের সৃষ্টিশীল অধ্যায় এবং তাঁর মর্মন্তুদ হত্যারহস্যে অনুসন্ধানী আলো ফেলা হয়েছে তাঁর নিকটজন মতিউর রহমানের সম্পাদনায় আজ জহির রায়হানের ৫০তম শহীদ দিবসে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা বইটিতে।
ভূমিকার প্রারম্ভেই পাই প্রামাণ্য এক জহির রায়হানকে, ‘জহির রায়হান বাংলার সেই বিরল কথাশিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, যিনি মানুষের মুক্তির প্রেরণায় তাঁর সৃজনশীল হাত এবং প্রবল পদাতিক সত্তা একই সঙ্গে সক্রিয় রেখেছেন। সাহিত্যজীবনের শুরুতেই “ওদের জানিয়ে দাও” কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী শক্তিকে জানাতে চেয়েছেন—তিনি তাদের বিরুদ্ধে, গণমানুষের পক্ষে কথা বলতে এসেছেন।’
গণমানুষের পক্ষের এক দীপ্ত স্বর আমরা খুঁজে পাব এ বইয়ে। এতে তাঁর স্বজন ও সমসাময়িকদের স্মৃতিচারণা, মূল্যায়ন, তাঁর নির্বাচিত রচনা, অগ্রন্থিত চিঠি, সাক্ষাৎকার, দুর্লভ আলোকচিত্রগুচ্ছ এবং তাঁর হত্যারহস্য নিয়ে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে।
বইটি এক অর্থে একই সঙ্গে জহির রায়হানের জীবন-পরিক্রমা এবং তাঁর মৃত্যুরহস্য উন্মোচনী প্রয়াস।
ভূমিকায় মতিউর রহমান এ বইয়ের ‘অনুসন্ধান’ পর্বটি বিশদ করেছেন এভাবে, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর আর মুক্তিসংগ্রামী সাহিত্যশিল্পী জহির রায়হানের হত্যাকাণ্ড প্রায় সমান বয়সের। “হত্যাকাণ্ড” সচেতনভাবেই বলছি আমরা; কারণ, আমাদের গবেষণা ও অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে এটি প্রমাণিত সত্য যে “অন্তর্ধান” নয়, জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধের পর মিরপুরে অগ্রজ সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের অনুসন্ধান-যুদ্ধে অবাঙালি ঘাতকগোষ্ঠীর হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বন্ধু সাংবাদিক-গবেষক জুলফিকার আলি মাণিক একাত্তর-উত্তর সময়েও পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর-কবলিত যে মিরপুরকে বলেছেন “মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন”।’
মৃত্যুরহস্য বিষয়ে একগুচ্ছ লেখার সংযোজনে অর্থাৎ শেষ থেকে শুরু হয়েছে এ বই। কারণ, জহির রায়হানদের কোনো মৃত্যু নেই। বইয়ের শুরুতেই শামসুর রাহমানের শিউরে ওঠার মতো লেখা, ‘জহির রায়হানের প্রত্যাবর্তন’, ‘জহির রায়হান নিখোঁজ হননি, শহীদ হয়েছেন একাত্তরের ঘাতকদের গুলিবৃষ্টিতে। গুলি ঝরেছে বৃষ্টির মতোই, কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়েও জহির রায়হান হয়তো বেঁচে ছিলেন। ঘাতকের দল আমাদের প্রিয় মানুষটিকে টেনেহিঁচড়ে পানির ট্যাংকের কাছে নিয়ে যায়।’
এই পর্বের আর তিনজন লেখক—শাহরিয়ার কবির, জুলফিকার আলি মাণিক এবং জহির-পুত্র অনল রায়হান—৩০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর ধোঁয়াশাভরা অধ্যায়কে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য এবং চুলচেরা বিশ্লেষণে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। ‘পিতার অস্থির সন্ধানে’ শিরোনামের সুদীর্ঘ-অনুপম-সজল লেখাটি শুধু পিতাহারা পুত্রের নয়, বরং স্বজনহারা বাংলাদেশের আর্তি, ‘মিরপুরের এই নতুন বধ্যভূমির অস্থিগুলো সামনে রেখে নতুন করে আমিও অতীত খুঁড়ে পিতার অস্তিত্ব সন্ধান করলাম। একসময় মনে হতো পিতা এসে দাঁড়াবেন, আমার মাথায় হাত রাখবেন। আমি মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া একটি মাথার খুলির ওপর হাত রেখে চিহ্নিত করতে চাইলাম পিতাকে। হয়তো একই করোটিতে হাত রাখবে আরও কয়েক শ জন, কয়েক সহস্রজন। বলবে, এ আমার পিতা। এই তো আমার ভাই, এই তো আমার বোন...।’
স্মরণ অংশ ঋদ্ধ হয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রাবেয়া খাতুন, সুচন্দা ও মতিউর রহমানের লেখায়। ‘অপু-তপুকে’ শিরোনামে জহির রায়হানের দুই পুত্রের প্রতি পত্রপ্রবন্ধে যেমন মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জহির রায়হানের পরিচয় উদ্ভাসিত হয়, তেমনি জহিরকে যথার্থভাবে আবিষ্কারের কথা উঠে আসে, ‘তোমরা বড় হয়ে নিশ্চয়ই জহিরের খোঁজ করবে। আর জহিরের খোঁজ নিতে গিয়ে শহীদুল্লারও খোঁজ করতে হবে। তাঁদের দেহের নয়, তাঁদের মনের খোঁজ তোমাদের খুঁজে পেতে হবে।’
সদ্য প্রয়াত কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুনের দীর্ঘ স্মৃতিবয়ানে পঞ্চাশ দশকের সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতার ও বন্ধুবৃত্তে নিবিড় এক জহির রায়হানকে পাই, ‘বিষয়বস্তু বদলাচ্ছিল। সঙ্গে বদলাচ্ছিল চোখমুখ। ওর চেহারায় ভেসে বেড়াত প্রায় সার্বক্ষণিক পবিত্র তারুণ্য। চোখে সহজভাবে দেখার দৃষ্টি। সে দৃষ্টি পাল্টাচ্ছিল। বাইরের জগৎকে শুধু সারল্যের মাপে একবারে আর মাপতে চাইত না। যুক্তি-বুদ্ধির মধ্যে টেনে আনত। বিশ্লেষণের পর আসত বিশ্বাসে। ফলে সুকুমার ভাব প্রচ্ছন্ন থেকে স্পষ্ট হচ্ছিল শক্ত পৌরুষে।’ ‘জহির ফিরে এল না’ রচনায় সুচন্দা জহির রায়হানের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, প্রণয়, পরিণয় এবং জহির-প্রয়াণ নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন।
‘জীবনের একটু আগুন চাই’ লেখায় বইয়ের সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের বিবরণ দিয়ে অশেষ জহির রায়হানকে স্মরণ করেন, ‘আজও তাঁকে স্পষ্ট দেখি, ১৯৭২ সালের জানুয়ারির কোনো একদিন সকালে পিজি হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে জহির রায়হান নামছেন, আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। তিনি হাত তুলে বললেন, “কেমন আছেন, কথা আছে, আসবেন।” আমি বললাম, আসব, কথা হবে। জহির ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হলো না, তাঁর সঙ্গে আর কোনো কথা হলো না।’
এ বইয়ের তাৎপর্যবাহী অংশ অনল রায়হানের উদ্ধার করা স্ত্রী সুমিতা দেবীকে লেখা জহির রায়হানের সুদীর্ঘ চিঠি। ব্যক্তিগতের পরিধি ছাপিয়ে যেন দার্শনিক অনুভবে উত্তীর্ণ, ‘বলব। হ্যাঁ, পাগল। তুমি আমি সে। আমরা সবাই এক একটা পাগল। বদ্ধ পাগল। পাগল ছাড়া আর কী?’
‘পরিশিষ্ট’ অংশে ১৯৭৩ সালে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের উদ্যোগে সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত জহির রায়হান স্মৃতিপুস্তিকা থেকে সংগৃহীত হয়েছে সহোদর জাকারিয়া হাবিব, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এবং চলচ্চিত্রজন আলমগীর কবিরের চারটি স্মৃতিমর্মরিত লেখা। ‘জহির: একটি চেতনা’ শিরোনামে আলমগীর কবিরের স্মৃতিতর্পণে যেন মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে উদ্ভাসিত হন মুক্তিসংগ্রামী জহির রায়হান, ‘জহির ঘরে নেই। স্টুডিওতে। দিন নেই, রাত নেই, ঘুম নেই—স্টপ জেনোসাইড তৈরি করছে। ও জানত, বাংলার স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রচারই যথেষ্ট নয়। বিশ্বের সকল পরাধীন শোষিত মানুষের সংগ্রামের সাথে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের একাত্মতা বোঝাতে হবে এই ছবির মাধ্যমে।’
ভাষাসংগ্রামী জহির রায়হানের একুশের অঙ্গীকার ছিল, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।’ মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর ও ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর সমাগত। আমাদের ইতিহাসের এই দুই মহান পর্বের প্রাক্কালে জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা অন্তরঙ্গ ও প্রামাণ্য পরিচয়ে তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছে তুলে ধরবে একুশ-একাত্তরের অভিষিক্ত জহির রায়হানকে। বইয়ের সম্পাদক মতিউর রহমানের ভূমিকার ভাষায়, ‘জহির রায়হানদের কখনোই মৃত্যু ঘটে না; “একুশের গল্প”-এর তপুর মতো জহির রায়হানরা “সময়ের প্রয়োজনে”, যুগে যুগে ফিরে ফিরে আসেন বাংলার লাখো-কোটি শহীদের বেশে।’