উফ! বাংলাদেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকের উল্টো দিকে রোকেয়া হলের দেয়ালে আঁকা হয়েছে এই দেয়ালচিত্র। ১১ অক্টোবরে।  ছবি: আবদুস সালাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকের উল্টো দিকে রোকেয়া হলের দেয়ালে আঁকা হয়েছে এই দেয়ালচিত্র। ১১ অক্টোবরে। ছবি: আবদুস সালাম
>

• ঢাকার দেয়ালে দেখা গেছে নতুন দুটি গ্রাফিতি
• প্রতিবাদী ভাষায় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জন-আকাঙ্ক্ষার চিত্র
• এ ধরনের দেয়ালচিত্র ‘গ্রাফিতি’ নামে পরিচিত
• পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রাফিতির ব্যবহার দেখা যায়

আলোচিত ‘সুবোধ’ সিরিজের পর ঢাকার দেয়ালগুলোতে একের পর এক চিত্র এঁকে চলেছেন অচেনা আঁকিয়েরা। কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার পরপর নিশ্চুপ দেয়ালে আঁকা বিষয়ভিত্তিক এই চিত্রগুলো নতুন নতুন বার্তা নিয়ে হাজির হচ্ছে। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক দেয়ালে আঁকা দুটি চিত্র এখন ব্যক্তিপরিসর ছাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা ছড়াচ্ছে।

নতুন চিত্র দুটির একটি আঁকা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগন্নাথ হলের দেয়ালে। তাতে দেখা যায়, সিংহাসন ফুটো করে বেরিয়ে আসছে একটি পেনসিলের চোখা প্রান্ত। পাশে লেখা, ‘উফ!’ রোকেয়া হলের দেয়ালের চিত্রটিতে বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর রিমান্ড কক্ষের বাতি। পাশে মোটা হরফে লেখা, ‘বাংলাদেশ রিমান্ডে’।

এ ধরনের দেয়ালচিত্র ‘গ্রাফিতি’ নামে পরিচিত। সাধারণত কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার শিল্পিত মাধ্যম হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার দেখা যায়।

গ্রাফিতির সাম্প্রতিক এই ধারা সম্পর্কে চিত্রসমালোচক মোস্তাফা জামান বলেন, বাংলাদেশে দেয়ালচিত্রের এই ধারা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগে অনেকে ক্যানভাসে কিংবা কাগজে আঁকতেন। এখন হয়তো তাঁরা ভাবছেন, এই শিল্পকর্ম জনমানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। তাই তাঁরা যোগাযোগের সহজ একটা মাধ্যম হিসেবে দেয়ালচিত্রকে বেছে নিয়েছেন।

চিত্রসমালোচক ও দেয়ালচিত্র দুটো দেখেছেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, প্রথম চিত্রটিতে গদি ফুটো করে বোঝানো হয়েছে ন্যায়ের পক্ষের মানুষ সব সময় অন্যায়ের ভিত নাড়িয়ে দেয়। এখানে কলম ব্যবহার না করার ব্যাখ্যা, কলমের নিব ভাঙলে আর লেখা যায় না। কিন্তু পেনসিলের শিষ ভাঙলে তা দিয়ে আবার লেখা যায়। অর্থাৎ সত্য কিংবা ন্যায়ের পক্ষের মানুষদের দমনের চেষ্টা করা হলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা বারবার জেগে ওঠেন।

আর গোটা বাংলাদেশকে রিমান্ডে নেওয়ার চিত্রটি সম্পর্কে সমালোচক ও দর্শকদের ভাষ্য, সম্প্রতি শিক্ষার্থী আন্দোলনের পর যেভাবে ঢালাও বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তারই রূপক হিসেবে এটি আঁকা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, কাউকে শারীরিকভাবে রিমান্ডে নেওয়াই রিমান্ড নয়। নিরাপদ সড়ক কিংবা কোটার মতো ন্যায্য আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীদের রিমান্ডে নিয়ে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাকিদের মধ্যেও। এটা দেখে অন্যরা মানসিকভাবে রিমান্ডের ভীতিতে থাকবেন।

আরেক শিক্ষার্থীর মতে, শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয়, অন্য নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে নানা নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। আন্দোলনের পর তো শুধু কয়েকজন শিক্ষার্থীকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু নীতিমালা যেন বাংলাদেশের সব নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রিমান্ডে নিয়েছে।

কিছুদিন আগে রোকেয়া ও জগন্নাথ হলের এই দেয়াল দুটিতে ‘সহমত ভাই’ ও ‘হেলমেট ভাই’ নামের দুটি আলাদা গ্রাফিতি আঁকা হয়েছিল। দর্শনার্থীরা ‘সহমত ভাই’কে সংযুক্ত করেছিলেন সমাজে বিদ্যমান তোষামোদির চর্চার সঙ্গে। আর ‘হেলমেট ভাই’ সম্পর্কে তাঁদের মূল্যায়ন ছিল, এরা তোষামোদির চর্চাকারীদের পক্ষে কাজ করা পীড়নকারীদের দল।

ঢাকার দেয়ালে আগে-পরের সব গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে স্টেনসিল (লেখা বা আঁকার জন্য ছিদ্রময় পাত) ব্যবহার করে। এর আঁকিয়ে কিংবা আঁকিয়েদের পরিচয় এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিরোধ আন্দোলনে গ্রাফিতি অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠার নজির আছে। নিকট অতীতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, যুক্তরাষ্ট্রে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনে কিংবা বছর চারেক আগে যাদবপুরে শিক্ষার্থী নিগ্রহের প্রতিবাদে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনেও ছিল গ্রাফিতির উপস্থিতি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতি আঁকিয়ে ব্যাংসি এমন ১২টি দেয়ালচিত্র এঁকেছেন প্যারিসে, যার মাধ্যমে ইউরোপের বিতর্কিত অভিবাসন বিষয়, ফ্রান্সে হিজাবের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করা হয়।

ঢাকায় সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতি ব্যাপক আলোচিত হয়। গত বছর ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে আঁকা এই চিত্রগুলোতে সুবোধকে কখনো দেখা যায় খাঁচাবন্দী সূর্য হাতে পালাতে উদ্যত, কখনো সুবোধ জেলে বন্দী, কিংবা হতাশায় নুয়ে পড়া এক মানুষ। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি চিত্রে সুবোধ হাজির হয় আশাবাদের প্রতীক নিয়ে। সুবোধ সিরিজের এই চিত্রগুলোর সঙ্গে লিখিত বার্তাগুলোও ছিল অনেকটা বিমূর্ত। ঢাকার সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতির অনুপ্রেরণায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তাঁদের ক্যাম্পাসে একাধিক গ্রাফিতি এঁকেছিলেন। তাঁরা ঢাকার ‘সুবোধ’কে দেখেছিলেন তাঁদের দাবি আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে। এ নিয়ে দুই দেশের পত্রিকায় খবরও বের হয়।

তবে সুবোধ সিরিজের পর ঢাকায় আঁকা এখনকার গ্রাফিতিগুলোর ভাব-ভাষ্য অনেকটাই স্পষ্ট। ছবির চেয়ে বলায় জোর বেশি। যেমন গত জুনে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের দেয়ালে আঁকা একটি গ্রাফিতিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দাবি করা হয়। একই সময়ে রোকেয়া হলের দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে ধর্ষকের ফাঁসি দাবি করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের দেয়ালে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের মুক্তি দাবি করে একটি গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। একই দাবিতে পরীবাগ সড়কের দেয়ালে আঁকা আরেকটি চিত্রে দেখানো হয়েছে, ‘সত্য’ জেলবন্দী।

এ বিষয়ে চিত্রসমালোচক মোস্তাফা জামানের ব্যাখ্যা হলো, এখনকার গ্রাফিতির প্রতীক (সিম্বল) বিস্তৃত নয়, ছোট। কারণ, অত সময় বোধ হয় পাওয়া যায় না। তাই সংক্ষিপ্ত আকারে, সুনির্দিষ্টভাবে বার্তাটা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে পরিস্থিতি সরাসরি উঠে আসছে।