ঈদের আনন্দ পূর্ণ হোক ত্যাগে
পবিত্র ঈদুল আজহার উদ্যাপনটা গত বছরও সীমিত ছিল, করোনাভাইরাস যেহেতু আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল, জীবন চলছিল কঠিন সব নিয়ন্ত্রণ মেনে। তবে আমরা আশাবাদী ছিলাম, হয়তো পরের বছর ঈদ আসবে সব ঘাটতি পুষিয়ে দিয়ে, আপদ নিশ্চয় তত দিনে বিদায় নেবে। সেই আশাবাদ বছর না ঘুরতেই ফুরিয়েছে, কোভিড নিঃস্ব করেছে অসংখ্য পরিবারকে, স্বজন ও উপার্জন হারিয়ে তারা চোখে অন্ধকার দেখছে। প্রান্তিক কৃষক থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছাঁটাই হওয়া শিক্ষক থেকে শ্রমিক—সবাই দাঁড়িয়ে এক অতল খাদের কিনারে, যা থেকে উঠে আসার কোনো পথ নেই। এই ঈদের মৌসুমে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ভয়ংকর হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
তারপরও ঈদ বলে কথা। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল থাকুক, মানুষ ঈদটা উদ্যাপন করতে চায়, বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলো সংযুক্ত হতে চায়, সংযুক্ত থাকলেও তা আরও দৃঢ় করতে চায়। সব ধর্মের উৎসবে প্রাণের সঞ্চার করে শিশুরা। কিন্তু এই ঈদে লাখ লাখÿ শিশু আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তারা যদি নিরানন্দে থাকে, কাপড়-জামা দূরে থাকুক, এক বেলার তৃপ্তির আহারও যদি তাদের না জোটে, ঈদটা সুন্দর হয় না। কিছু পরিবারের আনন্দ-আয়োজনটা যাঁরা নিশ্চিত করতে পারেন, যাঁদের সামর্থ্যের অভাব নেই, তাঁরা যদি হাত গুটিয়ে রাখেন, তাহলে ঈদের আনন্দটা সর্বজনীন হয় না।
ছেলেবেলায় আমরা শিখেছি, ঈদ মানে আনন্দ এবং ঈদুল আজহার প্রধান বাণী আত্মত্যাগের, যা হবে মানুষের কল্যাণে। বাংলার ক্লাসে আমরা ‘ত্যাগের মহিমা’ নিয়ে রচনা লিখতাম। ত্যাগ যে শুধু ব্যক্তির নয়, সমাজের, এবং সমাজ থেকেও বড় যে কাঠামো অর্থাৎ রাষ্ট্রের, তারও, সে কথাটাও আমরা ব্যাখ্যা করতাম। আমরা যে নতুন উপনিবেশী রাষ্ট্রে বাস করতাম, তার ত্যাগ অবশ্য তোলা ছিল সুবিধাভোগী কিছু পরিবার ও মানুষের জন্য। আমাদের জন্য তোলা ছিল শোষণের সব ছলাকলা।
আমাদের শিক্ষক চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। রাষ্ট্র নিয়ে তিনি হয়তো ভাবতেন। মানুষের অধিকার নিয়েও। এবং ত্যাগের মহিমা নিয়েও। তাঁকে অবশ্য কোনো দিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
গত বছরের ঈদে ওই রচনাটি বিস্মৃতির ধুলা সরিয়ে সামনে এসে হাজির হয়েছিল। আমি আশান্বিত হয়েছিলাম, যেভাবে কিছু তরুণ, সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান বিপন্ন পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাদের জন্য খাবার ও শিশুদের জন্য জামাকাপড় জোগাড় করেছিল, অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল, তাতে ত্যাগের আদর্শটা একসময় মহামারির কঠিন কালেও মানুষকে পথ দেখাবে। কিন্তু বিপুল চাহিদার বিপরীতে তাদের সামর্থ্য ছিল সামান্য। তাদের সীমিত উদ্যোগেও একসময় ভাটা পড়ল।
‘ত্যাগের মহিমা’ রচনাটি এবারও ছেলেবেলার সরল পাঠের একটা মর্মার্থ উপহার দিল। ত্যাগ তো শুধু ব্যক্তি করবে না, সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও তা করতে হবে। অনেক পরিবারের সঙ্গে স্বপ্নদর্শী এসব তরুণ বা সংগঠন যুক্ত হলেও ঈদের আনন্দ সর্বজনীন হবে না। এ জন্য প্রয়োজন সব পর্যায়ের মানুষের এবং সংগঠনের ত্যাগের মানসিকতা।
যে ভয়ংকর মারির দিনে এই ঈদটা এসেছে, সেই মহামারি একটু স্থায়ী হলেই হতদরিদ্রের সংখ্যা কয়েক কোটিতে পৌঁছাবে, নিম্নবিত্ত তাদের বিত্ত হারিয়ে দরিদ্রের কাতারে দাঁড়াবে। মধ্যবিত্তও হাঁটবে টানা দড়ির ওপর। ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধি হবে, প্রবৃদ্ধির হিসাবে হয়তো সংখ্যা যোগ হবে, কিন্তু গরিবি ব্যাপক হবে। আর যে গরিবি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না, কিন্তু যা সব নষ্ট করে দেয়, এবং যার পরিচয় দীনতায় এবং লজ্জায়, যার নাম মনের গরিবি, তা–ও ভয়াবহভাবে বাড়বে। এই গবিরির কাছে শিক্ষাও হার মানে, জাতির অহংকারকে তা কেড়ে নেয়।
রচনাটি জানিয়ে দিল, ত্যাগের প্রকারভেদ আছে। মানুষের সঙ্গে খাবার ভাগ করে নেওয়া, নিজের সামান্য সঞ্চয় থেকে অন্যকে কিছু দেওয়া, এই ত্যাগটা মহিমাময়। কিন্তু যাঁরা সামনে থেকে মহামারির সামাল দিচ্ছেন—ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, জরুরি সেবাদানকারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, প্রান্তিক কৃষক, শ্রমিক—তাঁরাও ত্যাগের মহিমার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু ত্যাগ মানে তো নিজের প্রিয় কিছু বিসর্জন দেওয়াও। কথাটা একটু ঘুরিয়ে বললে এভাবেও তো একটা ব্যাখ্যা তৈরি হয়, যে অভ্যাসগুলো আমাদের পছন্দের, যা আমাদের ব্যাংকের হিসাব স্ফীত করে, যেগুলো বিসর্জন দিলে মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে, সেসব থেকে যদি আমরা বিরত থাকি, তাহলে তার সামষ্টিক প্রভাব অনেক মানুষের জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে আনবে।
এই ঈদে যদি আমরা একটা সংকল্প গ্রহণ করি যে কৃষকদের হাতে তাঁদের পণ্যের সঠিক দামটা পৌঁছে দেব, শ্রমিকদের বেতন ও পাওনা মিটিয়েও কিছু অতিরিক্ত টাকা তুলে দেব, অকারণ ছাঁটাই বন্ধ করব, তাহলে ঈদের আনন্দটা আগামী ঈদেও তাঁদের ঘরে থেকে যাবে। প্রতিদিন যে লুটপাট আর দুর্নীতিকাণ্ডে আমরা লিপ্ত হই, তা যদি একটা বছর আমরা অর্ধেকেও নামিয়ে আনতে পারি, সমাজ যদি গরিবি হটাতে পথে নামে, রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কাঠামোয় ঢুকে পড়া বৈষম্য তৈরির চর্চাগুলো একটা বছর স্থগিত থাকে, রাষ্ট্র যদি আরও দরিদ্রবান্ধব হয়, তাদের অধিকারের প্রতি আরও মনোযোগী হয়, যদি তার তহবিল উন্মুক্ত থাকে প্রান্তিক মানুষ ও শিশুদের জন্য, তাহলে আগামী ঈদে ঘরে ঘরে আনন্দ পৌঁছে যাবে। তাহলে মনের গরিবিটাও বাড়বে না।
ত্যাগের মহিমার কোনো অন্ত নেই, আমার শিক্ষক বলতেন। মহামারি তা আমাদের ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
ঈদে মানুষ বাড়ি যায়। যেভাবে পারে, যায়, এবারও যাচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে সংযুক্তিটা বড় আনন্দের। সবার বাড়ি যাওয়া নির্বিঘ্ন হোক। পাশাপাশি, এই কঠিন সময়ে মহামারির বিষটা যেন আর না ছড়ায়, সেই চেষ্টাটা আমরা যেন নিরন্তর করে যাই।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।