আয় কমেছে ৬৭ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার
কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের নারী উদ্যোক্তাদের ১০ জনের ৯ জন কোভিড-১৯ মহামারিতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের শিকার হয়েছেন। অপরদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে ১০ জনের মধ্যে ৮ জন নারী কর্মী এ ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে আয় কমেছে ৬৭ শতাংশ উদ্যোক্তার এবং ৬৬ শতাংশ কর্মীর। সরকারঘোষিত প্রণোদনা পেতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ধারণা নেই ৫৭ শতাংশ উদ্যোক্তা ও কর্মীর।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘কাজে এবং ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত নারী’ শিরোনামে ব্র্যাক আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সংলাপে কোভিড-১৯ মহামারিতে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের নারী উদ্যোক্তা ও অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের পরিস্থিতি নিয়ে ব্র্যাকের গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এ আয়োজনে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী উদ্যোক্তা-কর্মীদের অনেকে সঞ্চয় ভেঙে চলেছেন। অনলাইন ব্যবসায়ী, পোশাকশিল্প কারখানা এবং এ–সংক্রান্ত সামগ্রীর উদ্যোক্তারা, নির্মাণশ্রমিক ও ভাসমান হকাররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। করোনাকালে উদ্যোক্তাদের গড়ে ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার টাকার বেশি।
বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম। বৈঠকে অংশ নেন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, ইউসেপ বাংলাদেশের চেয়ারপারসন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মাইডাসের সাবেক চেয়ারপারসন পারভিন মাহমুদ, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ, রপ্তানিকারক উদ্যোক্তা তরঙ্গ–এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর ইয়াসমিন, বেসরকারি সংগঠন কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া রফিক এবং ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স ও আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন বিভাগের ঊর্ধ্বতন পরিচালক শামেরান আবেদ। অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ বিভাগের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের জেন্ডার, জাস্টিস, ডাইভারসিটি বিভাগের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী।
মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি বুঝতে ৮ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্র্যাকের জরিপটি চালানো হয় আট বিভাগের ২৮টি জেলায়। জরিপে অংশ নেন ১ হাজার ৫৮৯ জন নারী উদ্যোক্তা ও কর্মী। এর মধ্যে ২৬ শতাংশের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। জরিপে অংশগ্রহণকারী উদ্যোক্তা ও কর্মীদের মধ্যে ছিলেন পোশাকশিল্প কারখানা ও এ–সংক্রান্ত সামগ্রী, বিউটি পারলার, কৃষি, দরজি, খুচরা দোকানি, পাটজাত পণ্য ও হস্তশিল্প, ভাসমান হকার, খাদ্য প্রস্তুতকারী, নির্মাণশ্রমিক, যৌনকর্মী ইত্যাদি। এ অর্থনৈতিক উদ্বেগের মধ্যে পারিবারিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছেন এক-তৃতীয়াংশ উদ্যোক্তা এবং অর্ধেক সংখ্যক কর্মী। কেউ কেউ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম বলেন, কোভিড পরিস্থিতিতে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের মূল মনোযোগ রয়েছে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়। এ সময়ে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা সবার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় কেটে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১টি নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুসারে সরকারের প্রস্তুতি চলছে। মানুষকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি দিতে সব ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে।
বৈঠকে বিল্ড-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন শিথিল করা প্রয়োজন। ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণসহায়তা দিলে তত সুবিধা হবে না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি নিতে হবে।
ইউসেপ বাংলাদেশের চেয়ারপারসন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মাইডাসের সাবেক চেয়ারপারসন পারভিন মাহমুদ বলেন, ব্যবসার জন্য পুঁজির পাশাপাশি আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় জড়িত। কোভিডে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে এগোতে হবে।
জরিপে বলা হয়, উদ্যোক্তাদের মধ্যে অর্ধেকের বিনিয়োগের উৎস হচ্ছে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘আগের ব্যবস্থায় যে বৈষম্য ছিল, তা কোভিডের সময়ে ধরা পড়েছে। এখন ভাবতে হবে সংকট উত্তরণের পথে আমরা আগের জায়গায় ফিরে যাব, নাকি পুনর্গঠন করব। রাষ্ট্র ব্যবস্থা না নিলে বারবার এই রকম সংকটে পড়তে হবে।’ তিনি বলেন, নারীর মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেন এ সংকটে আরও প্রান্তিক হয়ে না পড়ে, সে লক্ষ্যে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নারীদের প্রাধান্য দিয়ে দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।
বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, সরকার আর্থিক ক্ষতি কাটাতে ঋণসহায়তা দিতে যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, তা এনজিওর মাধ্যমে দেওয়া সুবিধাজনক। কারণ, বেশির ভাগ মানুষের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ধারণা নেই।
ব্র্যাকের জরিপে বলা হয়েছে, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এক হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা বরাদ্দ হয়েছে। তবে নারী-পুরুষ দুই ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশ ছাড় হয়েছে। কোভিড-১৯–এ সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় নেই অর্ধেকের বেশি কর্মী। ৫৭ শতাংশ কোনো সহায়তা পাননি।
কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া রফিক বলেন, পোশাকশিল্প কারখানায় চাকরি হারিয়েছেন, এমন কিছু কিছু নারী প্রণোদনা সহায়তা পেয়েছেন। তবে নারী কর্মীদের একটি বড় অংশ গৃহকর্মে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা এই সময়ে অর্থের অভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
ব্র্যাকের মাইক্রো ফাইন্যান্স ও আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন বিভাগের ঊর্ধ্বতন পরিচালক শামেরান আবেদ বলেন, নারী ও পুরুষ দুই ক্ষেত্রেই চাহিদার তুলনায় ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারাই ঋণ পান না। সেখানে নারী উদ্যোক্তারা আরও পান না। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংক হয়ে এনজিওর কাছে যখন বরাদ্দ আসে, তখন ৪-৫ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়ে যায়। এভাবে প্রণোদনার সহায়তা অকেজো হয়ে পড়ে।
তরঙ্গের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর ইয়াসমিন বলেন, জুন মাস থেকে পাটজাতশিল্পের জন্য বেশ কিছু বিদেশি চাহিদা তৈরি হয়েছে। কারণ, পাটজাত পণ্য প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব এবং এ পণ্য তৈরি করছেন নারীরা। এসব কারণে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান পণ্য কিনতে চাইছে। সুযোগটি নিতে নারী উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বৈঠকে প্রণোদনা সম্পর্কে সচেতন করা ও প্রণোদনা পাওয়ার সুযোগ তৈরি, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়ানো, নারী উদ্যোক্তা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জন্য একটি জাতীয় ডেটাবেইস তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।