আবুল বরকত সকাল থেকেই ব্যস্ত ছিলেন মধুর রেস্তোরাঁয়। তাঁর হাতে ছিল পোস্টার। লম্বা মানুষটা হাতে পোস্টার নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন মধুর রেস্তোরাঁয়। মোহাম্মদ সুলতান তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, পোস্টার নিয়ে ঘুরছ কেন, বরকত?
বরকত বললেন, আরে আমার হাত লম্বা দেখে ওরা সবাই পোস্টার লাগানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। দেখুন না আমি কী রকম উঁচুতে পোস্টারগুলো লাগাচ্ছি। অল্প কটা বাকি আছে, লাগিয়ে দেই।
আবুল বরকত ছিলেন অস্বাভাবিক লম্বা। মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে তাঁদের পরিবারটির নামই ছিল ‘টল ফ্যামিলি’। তাঁর বাবা শামসুজ্জোহাও ভীষণ লম্বা। এত লম্বা যে বহু দরজায় ঢোকার সময় তাঁর মাথা চৌকাঠে আটকে যায়। তিনি মাথা নিচু করে দরজা পার হন। সেই টল ফ্যামিলির ছেলে আবুল বরকত বছর চারেক আগে চলে এসেছেন পূর্ব বাংলায়। পুরোনো পল্টন লাইনে তাঁর মামা আবদুল মালিক থাকেন। বরকত থাকেন সেই মামার বাসা ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’য়। তিনি ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পরীক্ষার ফলও তাঁর ভালো হচ্ছে। গত বছর অনার্স পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪র্থ স্থান অধিকার করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়েন, আর আবুল বরকত ভাবেন, কাকে বলে রাষ্ট্র আর কাকে বলে দেশ। একটাই দেশ ছিল, মুর্শিদাবাদ আর ঢাকা, সিরাজউদ্দৌলার মুর্শিদাবাদ আর শায়েস্তা খাঁর ঢাকা। ১৯৪৭-এ মাউন্টব্যাটেন কলম দিয়ে দাগ টানলেন, আর দেশটা দুই ভাগ হয়ে গেল। তার মা থেকে গেলেন মুর্শিদাবাদে, আর তিনি এলেন ঢাকায়। কোনটা তাঁর দেশ, কোনটা তাঁর মাতৃভূমি?
কিন্তু মাতৃভাষা কী, তা নিয়ে আবুল বরকতের কোনো দ্বিধা ছিল না। বাংলা ভাষার মর্যাদা তাঁর কাছে মায়ের মর্যাদারই সমান। তাঁর হাতের একটা পোস্টারে লেখা: ‘নাজিম, চুক্তি পালন কর, নইলে গদি ছাড়। রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম আমাদের জীবন-সংগ্রাম’।
সাদা কাগজে লাল কালিতে লেখা। এ যেন আবুল বরকতেরই মনের কথা। রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম আর তাঁর জীবন-সংগ্রাম এখন একবিন্দুতে এসে মিলেছে।
আর চুক্তিটা হলো সেই ’৪৮ সালের চুক্তি। যেই চুক্তি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামেরা করেছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে, ৮ দফা চুক্তি, যার একটা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন। যেই চুক্তি জেলখানায় শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ অনুমোদন করেছিলেন।
নীল রঙের হাফ শার্ট, খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল—সদা বিনয়ী এই ছেলেটার কর্মতৎপরতার দিকে আরেক বার প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকান মোহাম্মদ সুলতান।
শামসুল হক রেস্তোরাঁর চেয়ারে বসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে কথা বলছিলেন। তখন হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে আবুল বরকতও উত্তেজিত হয়েছিলেন।
হাসান হাফিজুর রহমান কবিতা লেখেন। আবুল বরকতের সঙ্গে তাঁর বিশেষ রকমের বন্ধুত্বও আছে।
তারপর আবুল বরকত হাজারো ছেলের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে যান।
না, আবুল বরকত হারান না। তিনি আমতলার সভায় যান। আমরা কি ১৪৪ ধারার ভয়ে হার মানব? বক্তার এই প্রশ্নের জবাবে ‘না, না’ বলতে বলতে তিনি দুই হাত তোলেন। তাঁর লম্বা শরীরের লম্বা হাত আমগাছের পাতা স্পর্শ করে।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি সেই দৃশ্য দেখে হেসেই কুটিকুটি।
তাদের মনে হয়, আবুল বরকতের এই প্রতিবাদী হাতের মুঠো আমগাছ ফুঁড়ে ওই আকাশটাকেই যেন স্পর্শ করবে।
কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু হলে আরও অনেকের মতো আবুল বরকতও মধুর রেস্তোরাঁর পার্শ্ববর্তী দেয়াল টপকে মেডিকেল ক্যাম্পাসে ঢোকেন। সেখানে শুরু হয় ইষ্টক যুদ্ধ।
ছাপরার তৈরি ব্যারাকের মতো ঘরে মেডিকেল ছাত্রদের হোস্টেল। আবুল বরকত সেখানে গিয়ে অবস্থান নেন। অন্য ছেলেদের সঙ্গে তাঁরা ইট নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়তে ছুড়তে এগোন। আবার পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করে পুরো এলাকাটাকে ধোঁয়ায় ছেয়ে ফেলতে ধরলে তিনিও পিছিয়ে ব্যারাকের দিকে আসেন। চোখের জ্বলুনি থেকে বাঁচার কৌশল ছাত্ররা আবিষ্কার করেছে। বালতি, ডেকচি, হাঁড়ি-কলসি যা পাওয়া গেছে তাতেই পানি ভরে রাখা হয়েছে। ছেলেরা বারবার করে চোখ ধুয়ে নিচ্ছে। কেউ বা গায়ের কাপড় খুলে পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে চোখ মুছছে। এখানে মেডিকেলের ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র, কলা বিভাগের ছাত্র, বিজ্ঞানের ছাত্র—সবাই এসে জুটেছে। এটাই এখন প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। বাবুর্চিরা ইটের পালা থেকে ইট তুলে এনে ভেঙে ভেঙে ঢিল বানিয়ে স্তূপ করে রাখছে। সেখান থেকে ঢিল তুলে নিয়ে ছেলেরা ছুড়ে মারছে পুলিশের দিকে। আরও সাহসী ছেলেরা টিয়ারগ্যাসের শেল এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ধরে পাল্টা ছুড়ে মারছে পুলিশের দিকেই। এবার পুলিশও কাঁদানে গ্যাসের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।
লড়াইয়ের একপর্যায়ে আবুল বরকত আর তাঁর কজন বন্ধু একটু পিছিয়ে ২০ নম্বর ব্যারাকের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান নেন। একটুখানি জিরিয়ে নিয়ে আবার লড়াইয়ে নামতে হবে।
আবুল বরকতের লম্বা হাতে ঢিল ছোড়ার কাজটা হয় খুব ভালো। বিশ্রামের সময় তো এখন নয়।
মোহন মিয়া তখন সেখানে এলেন। আবুল বরকতকে ডাকলেন, আবাই। কী অবস্থা।
বরকত বললেন, চলুন, আবার যাই।
ওঁরা কেবল উঠেছেন, এমন সময় গুলির শব্দ। আর পড়ে গেলেন আবুল বরকত।
শফিকুর রহমান থাকেন ১৭ নম্বরে, এক বালতি পানি এনে ওঁর মাথায়, চোখেমুখে ঢেলে দিলেন। তিনি ভাবছেন, টিয়ারগ্যাসের প্রতিক্রিয়া।
ততক্ষণে রক্ত এসে মিশেছে পানির প্রবাহের সঙ্গে।
মোহন মিয়া বললেন, গুলি লেগেছে। ধরেন, হাসপাতালে নিতে হবে, ধরেন। চলেন।
মোহন মিয়া ধরলেন আবুল বরকতের মাথার দিকটা, শফিকুর ধরলেন পায়ের দিকটা। এত বিশাল বপুটাকে ওঁরা দুজনে ধরে নিতে পারেন! ভীষণ কষ্ট লাগছিল।
আরও দু–তিনজন এসে ধরল আবুল বরকতের পড়ে যাওয়া শরীরটা।
আবুল বরকত বললেন, ‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বাঁচব না। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টনে সংবাদ পৌঁছে দেবেন।’
তাঁকে নিয়ে ওঁরা ছুটছেন জরুরি বিভাগের দিকে। রেড ক্রস আঁকা ইমার্জেন্সির বারান্দায় উঠলেন তাঁরা। স্ট্রেচার কই। স্ট্রেচার।
স্ট্রেচারে শোয়ানো হলো বরকতকে। স্ট্রেচার বেয়ে রক্ত পড়ছে মেঝেতে। টুপটাপ। তাঁর পেটের চামড়া ঝুলে আছে স্ট্রেচারের বাইরে। তিনি বলছেন, পানি পানি।
মোহন মিয়া তাঁর ভেজা রুমালটা দিলেন বরকতের মুখে। বললেন, চোষো।
একজন নার্স সেই দৃশ্য দেখে পুলিশের উদ্দেশে বললেন, কাপুরুষ। আর মোহন মিয়াদের বললেন, আপনারা যান গেটে, প্রতিশোধ নেন। আমরা এনাকে দেখছি।
মোহন মিয়া প্রতিশোধের জন্য যাচ্ছেন। তখনই আরেকটা দেহ স্ট্রেচারে আসছে। তার মাথার খুলি হাঁ করা, সেখান থেকে যেন বেরিয়ে আসছে রক্তাক্ত বর্ণমালা।
মোহন মিয়া ফিরে তাকালেন। দেখলেন, আবুল বরকত স্ট্রেচার থেকে উঠে যাচ্ছেন। তাঁর শরীর লম্বা হচ্ছে। তাঁর মাথা ফুঁড়ে গেল হাসপাতালের ছাদ।
তাঁর শরীর আরও বড় হচ্ছে। তাঁর হাত আরও লম্বা হচ্ছে।
আর তখন আকাশ ভরা নক্ষত্র।
নক্ষত্রগুলোর গায়ে গায়ে বর্ণখচিত। অ আ ক খ।
আবুল বরকত হাসছেন আর একটা একটা করে বর্ণের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। বর্ণগুলো সব সোনালি থেকে লাল রং ধারণ করতে শুরু করেছে।
কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, পুরানা পল্টন লেইন বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে খবরটা দিতে হবে। সাইকেল কই, সাইকেল...
মোহন মিয়া জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।
আবুল বরকত তখনো, ওই সন্ধ্যায়, আকাশের গায়ে নক্ষত্রে নক্ষত্রে স্পর্শ করে চলেছেন বাংলা বর্ণমালা...ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলল, যা ভেবেছিলাম তাই, এই ছেলের হাত আকাশ স্পর্শ করল।
আর মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামে, জননী হাসিনা বেগম, হঠাৎ আকাশে তাকালেন। রাত তখন সাড়ে সাতটা, মুর্শিদাবাদে, ঢাকায় আটটা।
তিনি দেখতে পেলেন, আকাশে নক্ষত্রগুলোয় যেন আগুন লেগেছে, সব এত লাল। তিনি কারণটা ধরতে পারলেন না।
পরের দিন সন্ধ্যায় টেলিগ্রাম এল ঢাকা থেকে, আবুল বরকতের আব্বা শামসুজ্জোহা সেই বার্তা পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন, হাসিনা বেগম বুঝতে পারছেন না কী হয়েছে, ছেলের নিরাপত্তার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে ওপার বাংলায়, কলকাতায় কিংবা মুর্শিদাবাদে কখন কী বিপদ ঘটে, সেই ভয়ে, তাহলে কী ঘটল আবুল বরকতের! পাকিস্তান কি মুসলমানদের জন্য নিরাপদ নয়?
তিনি তাকিয়ে রইলেন আকাশে, তারার দলের দিকে, একই আকাশ, একই তারা, একই চাঁদের নিচে, দূরে কোথাও তাঁর ছেলে আছে, কেমন আছে সে?