গোলটেবিল বৈঠক
অভিবাসন ব্যয় শূন্যে নামানো জরুরি
‘করোনা-উত্তর বিশ্বে শ্রমিক অভিবাসন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজন করে প্রথম আলো ও আইএলও বাংলাদেশ।
করোনা মহামারির প্রভাবে অভিবাসন কমেছে। শুরুতে প্রবাসী আয় বাড়লেও কয়েক মাস ধরে কমতে শুরু করেছে। বিদেশের শ্রমবাজার ঘিরে নানা শঙ্কার মধ্যে নতুন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দক্ষ কর্মী তৈরির কোনো বিকল্প নেই। সারা দেশে আরও প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করা দরকার, প্রয়োজনে ভবন ভাড়া নিয়ে। অভিবাসন খরচও শূন্যের কোঠায় নামানো জরুরি।
‘করোনা-উত্তর বিশ্বে শ্রমিক অভিবাসন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সহায়তায় প্রথম আলো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গতকাল শনিবার ঢাকায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে এই গোলটেবিলের আয়োজন করে।
অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি ও সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, বিদেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে গরিব দেশের দর-কষাকষির ক্ষমতা থাকে না। প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে এবং দক্ষতার সনদের আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে হবে। তাহলে শ্রমবাজার খুঁজতে হবে না, বাজার নিজেই কর্মীদের খুঁজে নেবে। সব বাদ দিয়ে এখন দক্ষ কর্মী তৈরি করা দরকার।
শামীম হায়দার আরও বলেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতায়ন দরকার, যাতে অন্য সংস্থার ভরসায় না থেকে প্রবাসীসংশ্লিষ্ট সব কাজ নিজেরা করতে পারে।
গোলটেবিল বৈঠক থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাব প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে তুলে ধরবেন বলে জানান বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীর খায়রুল আলম। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের পর সৌদি আরব আর কোনো অদক্ষ শ্রমিক নেবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপেও দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। তাই দক্ষ কর্মী তৈরি করতে জোর দেওয়া হচ্ছে।
খায়রুল আলম আরও বলেন, প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) বানাতে হলে ১২ হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বছরে বরাদ্দ ৭০০ কোটি টাকা। বর্তমানে সব টিটিসি চলছে সনাতনী কায়দায়। এসব বদলাতেও প্রচুর বিনিয়োগ দরকার।
আইএলও বাংলাদেশের মাইগ্রেশন প্রকল্পের প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা লেটিশিয়া ওয়াইবেল রবার্টস বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অভিবাসন খাতে সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা আছে। অভিবাসন খাতের প্রতিটি ধাপে অংশীদারি নিশ্চিত করা দরকার, বিশেষ করে কর্মী পাঠানো ও গন্তব্যসংশ্লিষ্ট দুই দেশের মধ্যে। সব অংশীদারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ বলেন, মহামারির প্রভাবে কয়েক লাখ প্রবাসী কর্মী ফিরে এসেছেন। মহামারি না থাকলেও প্রতিবছর প্রবাসীরা ফিরে আসবেন, তাঁরা কেউ স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকেন না। দেশে ফেরার পর তাঁদের কাজে লাগানোর বিষয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান বলেন, করোনার আঘাত থেকে পাল্টা সম্ভাবনা তৈরি করতে হবে। প্রবাসী কর্মীদের জন্য কম খরচে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রীলঙ্কা, নেপালের চেয়ে অভিবাসন ব্যয় এখানে অনেক বেশি।
তবে সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টের কো-চেয়ার সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো
হচ্ছে অভিবাসীর অধিকার, বৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রক্রিয়া, অবৈধ হয়ে পড়া শ্রমিকদের নিয়মিত করা ও নিয়মিত কর্মী পাঠানো ধরে রাখা এবং কর্মীর দক্ষতা সনদের স্বীকৃতি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন বলেন, প্রবাসী আয়প্রবাহ বিশ্লেষণ, দক্ষ কর্মী তৈরি, স্থানীয় পর্যায়ে বিএমইটির সেবা নিয়ে যাওয়া, পুনরেকত্রীকরণ ঋণ সহজ করা দরকার।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, নারী অভিবাসন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ একটিমাত্র খাতে আগাম প্রবাসী আয় আসে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী জাফর সাদিক বলেন, করোনার পর অভিবাসন ব্যয় আরও বেড়েছে, এটি আগে থেকেই অন্য দেশের তুলনায় বেশি ছিল। আগামী পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য খাতে নার্স পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নিতে হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, গত বছর আগের মতো অভিবাসন হয়নি। প্রবাসী আয় ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। জাপানসহ আঞ্চলিক দেশগুলোর শ্রমবাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসোশ্যালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনন্য রায়হান। গত দুই বছরে অভিবাসন ও প্রবাসী আয়ের উত্থান-পতন তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রবাসী আয়ের অবনমন মূল্যায়ন করা দরকার। এ ছাড়া ছয় লাখ অনলাইন শ্রমিক রেমিট্যান্স আনছেন। তাঁদের অভিবাসী মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
আইএলও বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার রাহনুমা সালাম খান বলেন, আনুষ্ঠানিক খাতে প্রণোদনা থাকলেও টাকা পাঠানো নিয়ে অনেকের ভীতি আছে। আবার লেনদেনের বিষয়ে ধারণার অভাব আছে কারও কারও। এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে টাকা আসে। অনানুষ্ঠানিকের চেয়ে আনুষ্ঠানিক খাতকে সহজ ও আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে হবে প্রবাসীদের কাছে।
গোলটেবিলের শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, শ্রমিক অভিবাসনসংকটে আছেন। অনেকে ফিরে আসছেন। আবার নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে। পরিস্থিতি উত্তরণে গবেষণা দরকার।
বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।