অন্য দিগন্তের দিশারি
রাজশাহীর এনায়েত হোসেন পবিত্র ওমরাহ বা হজ করার ইচ্ছে মনে মনে পোষণ করলে শিগগিরই তা পূরণ হতে পারে, এমনটি ভাবেননি। যেদিন তাঁর ছেলে নিয়ামত হোসেন তাঁকে এই সুখবর দেন, শুরুতে বিশ্বাসই করেননি। কারণ, নিয়ামত হোসেন একজন তড়িৎ প্রকৌশলী হলেও ওঁর চাকরিজীবন মাত্র শুরু হয়েছে। তারপরই তিনি জানতে পারলেন, নিয়ামত যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, সেখান থেকেই তাঁকে পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।
নিয়ামত চাকরি করেন ‘ফ্লিট বাংলাদেশ’-এ। এই প্রতিষ্ঠানের বয়সও তেমন না। এই তো সেদিন ২১ সেপ্টেম্বর এই প্রতিষ্ঠানটির তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা খায়রুল আলম। ফ্লিট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে কর্মীর বাবা অথবা মাকে হজ বা ওমরাহতে পাঠানোর জন্য এদের রয়েছে হজ ফান্ড। কর্মীদের বাৎসরিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে এ পর্যন্ত চারজন কর্মী এ সুযোগ পেয়েছেন। গত দুই বছর হজ বন্ধ থাকায় এবারই এনায়েত হোসেনসহ আরও তিনজন ওমরাহ করতে যাচ্ছেন।
‘আমি যদি আমার কর্মীদের ভালো রাখি, তাঁদের জন্য কাজ করি, তাহলে তাঁরা আমার প্রতিষ্ঠাকে এগিয়ে নেবে।’—আমার জিজ্ঞাসার জবাবে বললেন খায়রুল আলম। রাজশাহীর নওদাপাড়ায় ফ্লিট বাংলাদেশের সদর দপ্তরে আলাপ করছিলাম আমরা।
তখনই জানালাম, বিশ্বখ্যাত ফোর্বস আর এন্ট্রাপ্রেনিউর সাময়িকীতে খায়রুলকে নিয়ে যে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, দুটিতেই তাঁর এই কর্মী ধরে রাখাতে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেরা কর্মীদের মোটরসাইকেল দেওয়া, কর্মীদের বাসার কাছাকাছি অফিস নেওয়া, দূরবর্তী অফিসের ক্ষেত্রে যাতায়াত সুবিধা, কাজের ফাঁকে মনোরঞ্জনের জন্য বিলিয়ার্ড বা টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা করা, সব কর্মীকে বছরে একবার কক্সবাজার কিংবা এ রকম কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে একদল কর্মীকে দেশের বাইরে বেড়াতে পাঠানো—এই সবই খায়রুল করছেন তাঁর তিন বছর বয়সী প্রতিষ্ঠানে। এমনটি করলে কর্মিসংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে দক্ষ কর্মীর সংখ্যাও। তাই রাজশাহীতে অবস্থিত ফ্লিট বাংলাদেশের চারটি অফিসে এখন কর্মিসংখ্যা ৬০০ জনের বেশি। বেতনের বাইরে ক্যাশ ইনসেনটিভের কারণে এমন কর্মীরও আমি দেখা পেয়েছি, যাঁরা মাসে সাত অঙ্কের বেতন পান।
‘রাজশাহী শহর থেকে কাছেই বাইপাস রাস্তা–সংলগ্ন জায়গায় আমি ১০ একর জমি কিনেছি। উদ্দেশ্য ফ্লিট সিটি গড়ে তোলা। এখানে আমরা যাঁরা একসঙ্গে কাজ করছি, তাঁরা একসঙ্গেই থাকব। ফ্লিট বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য আবাসন–সুবিধা গড়ে তুলতে চাই।’ ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন ৩০ বছর বয়সী খায়রুল।
কিন্তু শুরুতে সবকিছু এত সুন্দর ছিল না। ছোটবেলাতেই বাবাকে হারানো খায়রুলের জন্য নিজের ও পড়াশোনার খরচ চালানোই ছিল কঠিন। ২০০৫ সালে টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে দেশি আইটি প্রতিষ্ঠান লিডসফট বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মপরিবেশ দেখে ভাবেন এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন। কিন্তু উপায় কী?
২০০৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ব্যবসায় প্রশাসনে। ঢাকায় থাকা ও পড়াশোনার খরচ জোগাতে টিউশনি করতেন। নিজের পড়ার সময়ের বাইরে বাকি সব সময় কাজ খুঁজতেন। এ সময় জানলেন, অনলাইনে কাজের সুযোগ আছে। তবে সে জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। দরকার একটি কম্পিউটারের। একটি পুরোনো কম্পিউটার কিনলেন ১৪ হাজার টাকায়। রাত জেগে জেগে নিজেকে তৈরি করে ফ্রিল্যান্সার ডট কমে শেষ পর্যন্ত একটি কাজ জোগাড় করলেও কাজের বিল পেলেন না। এতে অবশ্য দমে গেলেন না খায়রুল। জানতেন, ‘লেগে থাকলে কাজ আমি পাব। শুধু ভালোভাবে কাজ করতে হবে।’ এবার ওডেস্কে (বর্তমানে আপওয়ার্ক) নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে চেষ্টা করতে থাকলেন। অবশেষে আপওয়ার্কে পরপর দুটি কাজ করে পেলেন ভালো অঙ্কের টাকা। ‘তবে এর চেয়ে বড় কথা হলো আমি পেলাম দুজন গ্রাহকের খুব ভালো পর্যালোচনা। আমার প্রোফাইলে এই দুই পর্যালোচনা অনেককে আকৃষ্ট করল।’ তারপর থেকে কাজ পেতে শুরু করলেন খায়রুল।
খায়রুল আলম
তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা
জন্ম
২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০, রাজশাহী
পড়াশোনা
হামিদপুর নওদাপড়া পাইলট
উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক (২০০৫), রাজশাহীর নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক (২০০৭), আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে বিবিএ (২০১২) ও এমবিএ (২০১৩)
অর্জন
ফোর্বস ও এন্ট্রাপ্রেনিউর সাময়িকীতে প্রতিবেদন (২০২০ ও ২০২১)
নূরুল কাদের সম্মাননা (২০২০)
এর মধ্যে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি হয়েছে। চাকরি নিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দিনে চাকরি আর রাতে ফ্রিল্যান্সিং। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়লেন—এ কিউব। কাজও পেলেন কিন্তু টিকল না।
চাকরিটা ছাড়লেন না। ‘ভেবে দেখলাম যদি আমি রাজশাহীতে গিয়ে কাজটা করতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই আরও ভালো করতে পারব।’ কিন্তু টের পেলেন, রাজশাহী শিক্ষানগরী হলেও দক্ষ কর্মীরা পাড়ি জমান ঢাকায়।
খায়রুল আলম শুরু করলেন দ্বিতীয় ইনিংস। রাজশাহীর তরুণদের প্রশিক্ষিত করা। একজন–দুজন করে তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। এর মধ্যে খোঁজ পেয়েছেন ভিন্ন ধরনের কাজের। দেখলেন বিশ্বখ্যাত অনলাইন বিকিকিনির প্রতিষ্ঠান আমাজন, ওয়ালমার্ট কিংবা ই-বেতে অনেক অনেক ‘মার্চেন্ট স্টোর’। সারা বিশ্ব থেকে স্টোরগুলোর মার্চেন্টরা তাদের পণ্য এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে বিক্রি করেন। কিন্তু স্টোর ব্যবস্থাপনা, কাস্টমার সার্ভিস, উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ করতে গেলে স্টোরগুলো তাদের পণ্য উৎপাদন বা মূল কাজে পিছিয়ে পড়ে। এ কারণে তারা খোঁজে খায়রুলের মতো তরুণদের—যারা কিনা তাদের হয়ে গ্রাহকসেবা তথা অর্ডার গ্রহণ ও প্রক্রিয়াকরণ করা, গ্রাহকের অবস্থানভেদে লজিস্টিক বা কুরিয়ার সার্ভিস ঠিক করা, স্টোর থেকে শিপিং করার জন্য শিপিং লেবেল প্রিন্ট করে সেটি যথাযথ প্যাকেজে সেঁটে দেওয়া, তদারকি করা—এই কাজগুলো করবে। একই সঙ্গে তারা তাদের হয়ে কল সেন্টারও চালাবে। প্রতিটি স্টোরের পক্ষে একা একা এই কাজগুলো করা কঠিন ও কষ্টসাধ্য। খায়রুল ও তাঁর দল কাজগুলো তাদের হয়ে করে দেন। বিনিময়ে নির্ধারিত ফি ছাড়া বিক্রির ওপর কমিশনও পাওয়া যায়। এই সেবাগুলোর পোশাকি নাম হলো ভেন্ডর ও স্টোর ম্যানেজমেন্ট, ফুলফিলমেন্ট বাই আমাজন, ডেটা অ্যানালিটিকস ইত্যাদি। কাজেই খায়রুলের কর্মিসংখ্যা বাড়তে থাকে। সঙ্গে সুনামও। ফনেক্স গ্রুপ, অ্যাশলি ফার্নিচার, টমি রড্রিগেজ, টিঅ্যান্ডটি ইন্ডাস্ট্রিজ—এ রকম প্রতিষ্ঠানের সরাসরি গ্রাহকসেবার কাজও পেয়ে গেছেন।
এমন প্রায় ১ হাজার ২০০ স্টোরের কাজ করছে ফ্লিট বাংলাদেশ। কাজ করতে গিয়ে নতুন একটি ক্ষেত্রও পেয়ে যান খায়রুল। লক্ষ করলেন, এসব স্টোরের অনেক পণ্য ডেলিভারির পর গ্রাহক ফেরত দেয়। ‘তখন তাদের রিটার্ন লেবেল পাঠাই আমরা। কিন্তু দেখা গেল কোনো কোনো পণ্য উৎপাদক আর ফেরত নেয় না। তারা টাকাটা রিফান্ড করে কিন্তু আমাদের বলে তোমরা প্রোডাক্টের একটা কিছু করো।’ রিটার্ন প্রোডাক্ট ম্যানেজ করার জন্য প্রথমে একটা গোডাউন ভাড়া করলেন খায়রুল। পরে ভাবলেন, এগুলো নষ্ট করার চেয়ে একটা স্টোরই তো করে ফেলা যায়। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন পার্টনার নিয়ে চালু করে ফেললেন ফ্লিট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।
খায়রুল ভাবেন, কী করে আরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান করা যায়। সে জন্য দেশের মধ্যে কাজ করার জন্য আরও চারটি উদ্যোগ নিয়েছেন। এগুলো হলো ফিক্স অ্যাপের মাধ্যমে সব ধরনের সেবা দেওয়া। ফ্লেক্স ডট এআই নামে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে। রাজশাহীতে শুরু করেছেন ভিন্ন রকমের ই-কমার্স ফ্লিট-বাই এবং আইটি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফ্লিট সফট।
ফেরার সময় জানতে চাইলাম, দূর ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
‘ফ্লিট ও তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানকে আমি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আইটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চাই।’ অন্য দিগন্তের দিশারি খায়রুল আলমের কণ্ঠে ছিল আত্মপ্রত্যয়ের সুর।
মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানপ্রধান